২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বারবার রাতের আঁধারে আমগাছ কেটে চাষিদের সর্বনাশ, ধরা পড়ে না দুর্বৃত্তরা

রাতের অন্ধকারে কেটে ফেলা আমগাছের গোড়ায় বসে বিলাপ করছেন চাষি আবু সামা। গত সোমবার দুপুরে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার হাবাসপুর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

রাজশাহীর বাঘা উপজেলায় দুই দশকে অন্তত দেড় হাজার আমগাছ কেটে দিয়ে চাষিদের সর্বনাশ করেছে দুর্বৃত্তরা। রাতের আঁধারে একের পর এক এসব ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। এ নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় আছেন আমসমৃদ্ধ বাঘা উপজেলার চাষিরা।

সর্বশেষ গত রোববার (১১ ডিসেম্বর) দিবাগত রাতে উপজেলার হাবাসপুর গ্রামের ১৫ জন চাষির প্রায় ৪০০ আমগাছ কেটে ফেলা হয়। এর পাঁচ দিন আগে আরও পাঁচজন আমচাষির ১৩০টি গাছ কাটা হয়। এই দুটি ঘটনায় কোনো দুষ্কৃতকারী ধরা পড়েনি। ভুক্তভোগী চাষিরাও বলতে পারছেন না, কারা তাঁদের এমন সর্বনাশ করছে। তবে ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে এমনটি করা হতে পারে বলে ধারণা তাঁদের।

বলিহার গ্রামের বিমল চন্দ্র সরকারের ২৬ বিঘার ফল বাগান রয়েছে। ২০০০ সালের ২৮ আগস্ট থেকে ২০০৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত তাঁর বাগানে ৩০ বার হামলা হয়েছে।

হাবাসপুর গ্রামের আমচাষি সাধন কুমার রোববার দিবাগত রাতের গাছ কাটার ঘটনায় বাঘা থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন। গতকাল মঙ্গলবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ এসে দেখে গেছে। এত সাংবাদিক এল। একের পর এক খবর হচ্ছে, কিন্তু কোনো আসামি ধরা পড়েনি। পুলিশ বলছে, ‘নাম বলো, নাম বলো’। রাতের অন্ধকারের ঘটনা। তাঁরা কার নাম বলবেন?

আরও পড়ুন

সাধন কুমার বলেন, ‘২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আমাদের সাত-আটজন আমচাষির ১০০–এর বেশি আমগাছ কাটা হলো। তখনো কিছু হলো না। একজন আসামিও ধরা পড়ল না। গ্রামের সব জমিতেই আমগাছ। গাছ নিয়ে আমরা এখন বড় দুশ্চিন্তায় আছি।’

বাঘা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাজ্জাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অতীতে কী হয়েছে, তিনি তা জানেন না। তবে হাবাসপুর গ্রামের আমগাছ কাটার ঘটনাটি ‘সূত্রহীন’। তারা আসামি ধরার কোনো সূত্র পাচ্ছেন না। অনেক মানুষের গাছ কাটা হয়েছে। তাঁরা কেউই কারও নাম বলতে পারছেন না। পুলিশ চেষ্টা করছে।

উপজেলার বলিহার গ্রামের বিমল চন্দ্র সরকারের ২৬ বিঘার ফল বাগান রয়েছে। ২০০০ সালের ২৮ আগস্ট থেকে ২০০৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দুর্বৃত্তরা রাতের অন্ধকারে তাঁর বাগানে ৩০ বার হামলা করেছে। ৫০০টি আমগাছ কেটে ফেলা হয়েছে। ২০০৯ সালের ২২ নভেম্বর দিবাগত রাতে দুর্বৃত্তরা বাগানের একটি ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। এতে প্রায় ৫০ হাজার টাকার খড়িসহ (জ্বালানি) ঘরটি পুড়ে যায়। আগুনে একটি কাঁঠালগাছ পুড়ে যায়। ছয়টি বড় আমগাছের অংশ বিশেষ পুড়ে যায়। বিমল চন্দ্র সরকার ২০১৪ সালে মারা যান। তার আগে তিনি বাঘা থানায় ৫০টির বেশি সাধারণ ডায়েরি করেন। কিন্তু কোনো সাক্ষী জোগাড় করতে না পারার কারণে কোনো বিচার পাননি।

গাছ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন বাঘার আমচাষিরা। গত সোমবার দুপুরে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার হাবাসপুর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

সাধনের ছেলে বিশ্বজিৎ সরকার বলেন, একটি গাছ কাটার আসামিও ধরা যায়নি। বিচার হয়নি। বাবা মারা যাওয়ার পরে তাঁরা সবার সঙ্গে একটু মানিয়ে চলার চেষ্টা করছেন। সর্বশেষ গত দুই বছর আগে একটা ঘটনা ঘটেছিল। তাঁরা ছাড় দিয়ে আপস করে নিয়েছেন।

বিমল চন্দ্র সরকার ছাড়াও গত কয়েক বছরে বলিহার গ্রামে কার্তিক চন্দ্র সরকারের বাগানের ১৩টি আমগাছ, দিলীপ সরকারের দিনাজপুরী লিচুবাগানের ৩৪টি লিচু, ব্রজগোপালের বাগানের আটটি আমগাছ রাতের আঁধারে কেটে ফেলে দুর্বৃত্তরা। কার্তিক চন্দ্র সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তার আত্মীয় সুকুমার সরকার বলেন, কারও সঙ্গে প্রকাশ্য শত্রুতা না থাকায় তাঁরা থানায় কোনো অভিযোগ করেননি। কোনো দুষ্কৃতকারীও চিহ্নিত হয়নি।

উপজেলার চকসিংগা গ্রামে ২০০৭ সালের ৩১ অক্টোবর দিবাগত রাতে কার্তিক হালদারের চার বছর বয়সী ২৫টি আমগাছ কেটে ফেলা হয়। সাক্ষী না পাওয়ায় কার্তিক হালদার মামলা করতে পারেননি। সে সময় তিনি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, এ ঘটনার জন্য তিনি কাউকে সন্দেহও করতে পারছেন না। আবার এ ঘটনার সাক্ষীও নেই। তিনি কারও বিরুদ্ধে মামলাও করতে পারছেন না। সেই সময় পুলিশের পরামর্শে শুধু থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন।

=তবে ভুক্তভোগী একজন বাগানমালিকের মামলায় দুই আসামি গ্রেপ্তার হয়েছিল। মমিনুল ইসলাম নামের এই আমচাষি পেশায় একজন আইনজীবী। বাড়ি উপজেলার সোনাদহ গ্রামে। ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এক সপ্তাহের ব্যবধানে তাঁর ১১০টি গাছ কেটেছিল দুর্বৃত্তরা। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জমি নিয়ে একটি পক্ষের সঙ্গে তাঁর বিরোধ ছিল। এ নিয়ে মামলাও চলছিল। বিরোধী পক্ষের হয়ে দুর্বৃত্তরা তাঁর গাছ কেটেছিল। মামলা করার এক বছর পরে তিনি আসামিদের সঙ্গে আপস–মীমাংসা করে নিয়েছিলেন। সেই ক্ষেত্রে বলা যায়, তিনি বিচার পেয়েছিলেন।

বাঘায় আমবাগান কেটে ফেলার ঘটনা বেশ পুরোনো বলে জানালেন বাঘা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সফিউল্লাহ সুলতান। এটাকে ফৌজদারি অপরাধ উল্লেখ করে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হাবাসপুরের গাছ কাটার পরে তিনি ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি পুলিশকে সহযোগিতা করবেন। আর যে গাছগুলোর গোড়া ও কিছু ডাল রয়েছে, সেগুলোতে কলম করা যাবে। এ ব্যাপারে তিনি চাষিদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।

বাঘায় নতুন জাতের আমবাগান করছেন আধুনিক আমচাষি আসাফুদ্দৌলা। তিনি বলেন, এখানকার আমচাষিরা সব সময় বাগান নিয়ে একটা দুশ্চিন্তায় থাকেন—রাতের অন্ধকারে কে কার বাগানের ক্ষতি করে যায়।