দুই বন্ধুর চেষ্টায় গণকবরের ঝোপঝাড় এখন ফুলের বাগান

কাজ শেষে দুই বন্ধু ফুটপাতের নিরিবিলি স্থানে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিতেন। কখনো ঝালমুড়ি, কখনো বাদাম বেচতেন। তার উল্টো দিকেই সাত শহীদের গণকবর, স্মৃতির বেদি। মৌলভীবাজারের শাহ মোস্তফা সড়কের বেরিরপাড়-সংলগ্ন এই স্থানটিতে মুক্তিযুদ্ধে শহরের প্রথম শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ করা হয়েছে।

দুই বন্ধু দেখতেন, গণকবরের স্থানটি ঝোপঝাড়ে জঙ্গল হয়ে আছে। লোকজন স্থানটিতে ময়লা-আবর্জনা ফেলছে। স্থানটিকে কীভাবে সুন্দর ও সংরক্ষণ করা যায়, এ নিয়ে ভাবতে গিয়েই ছাইফুল ভান্ডারি ও জাহাঙ্গীর হোসেন তৈরি করেছেন একটি ‘ফুলবাগান’। ফুলবাগানটি এই দুজনের পক্ষ থেকে গণকবরের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি। বাগানটিতে এখন নানা রঙের গোলাপ ও জবা হাসছে।

মৌলভীবাজারের প্রবীণ সাংস্কৃতিক সংগঠক সৈয়দ আবদুল মোত্তালিব রঞ্জুর বাসা ওই এলাকাতেই (শাহ মোস্তফা সড়ক-সংলগ্ন দরগা মহল্লা)। সম্প্রতি তিনিই ছাইফুল ভান্ডারির খোঁজ দিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ছাইফুল ভান্ডারি দিনে রিকশা চালান, রাতে বাদাম বেচেন। গণকবরে খুব সুন্দর বাগান করেছেন। কয়েক দিন খোঁজ করার পর গত রোববার রাতে ছাইফুলের দেখা মেলে।

ছাইফুল ভান্ডারি জানালেন, তাঁর বাড়ি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে। প্রায় ১৭-১৮ বছর ধরে থাকেন মৌলভীবাজার শহরের দরগা মহল্লায়। দিনে রিকশা চালান। তাতে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় হয়। শীতকালে সন্ধ্যার পর গণকবরের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে বাদাম বেচেন। এ ছাড়া ঢালাইয়ের (ভবন নির্মাণ) কাজ পেলে সেদিন আর রিকশা চালান না। ঢালাইয়ের কাজে কিছু বাড়তি আয় হয়, ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। স্ত্রী, তিন মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে তাঁর সংসার। অপর দিকে তাঁর বন্ধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জাহাঙ্গীর হোসেন অনেক দিন ধরে শহরের সুলতানপুরে থাকেন। তিনি ঝালমুড়ি, চটপটি বেচেন।

বছর সাত আগে গণকবরের উল্টো দিকে ছাইফুল ও জাহঙ্গীর আড্ডা দিতেন। কখনো বাদাম, কখনো ঝালমুড়ি বেচতেন। তখনই তাঁদের চোখে পড়ে স্মৃতিস্তম্ভের পাশে অনেক আগাছা, ঝোপঝাড়; যার যা খুশি, আবর্জনা ফেলছে। বিষয়টি তাঁদের ব্যথিত করে। এখানে কিছু করা যায় কি না, এ নিয়ে প্রায় ছয় মাস চিন্তাভাবনা করেন তাঁরা। সরকারি জায়গা, কিছু করতে গেলে কে কী ভাবেন! পরে এখানে ফুলবাগান করেন দুই বন্ধু। সেটা নিয়ে কম কথা শুনতে হয়নি তাঁদের।

ছাইফুল ভান্ডারি বলেন, ‘অনেকে কয় আমরা জেলের ভাত খাইব। কেউ কয়, “খাইত পারে না, করব ফুলের বাগান।” প্রথম অবস্থায় পরিবারও (স্ত্রী) ঝামেলা করছে। কাজ না থাকলে দুই বন্ধু মিলি রাত–দিন কাজ করছি। একটা সময় সবাই চুপ হয়ে গেছে। প্রশংসা করছে। ফুল দেখে, বাগান দেখে পরিবারেও শান্তি। এই ফুলবাগান আমাদের পক্ষ থেকে শহীদদের প্রতি উপহার।’ এর সঙ্গে তিনি যোগ করেন, শুরুতে ১০-১৫টি গাঁদা ফুলের গাছ লাগানো হয়েছিল। ফুলও হয়েছিল অনেক। কিন্তু শুধু গাঁদায় তো আর বাগান হয় না। ফুলও সব সময় থাকে না। এক-দুইটা করে তাঁরা গোলাপ লাগানো শুরু করেন। লাল, সাদা, গোলাপি নানা রঙের গোলাপ। সঙ্গে নানা রঙের জবা।

ছাইফুল ভান্ডারি বলতে থাকেন, সাত বছর ধরে একটু একটু করে তাঁরা ফুলবাগান গড়ে তুলেছেন। নার্সারি থেকে চারা কেনেন। ১৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা একেকটি চারার দাম। কারও কাছ থেকে তাঁরা টাকা নেননি। নিজেদের টাকাতেই সব করেছেন। দীর্ঘদিন মোটর লাগিয়ে পানি দিয়েছেন। অনেক টাকা খরচ হয়েছে। তবে প্রায় সপ্তাহখানেক আগে স্থানীয় কাউন্সিলর আনিছুজ্জামান পানির একটি সংযোগ লাগিয়ে দিয়েছেন।

বাগানে গিয়ে দেখা যায়, গাছে গাছে অনেক গোলাপ ফুটে আছে। জবাও ফুটেছে। ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে আছে বাগানটি। বাতাসে ফুলের ঘ্রাণ। বাগানে ১৫ জাতের গোলাপ, ৩-৪ জাতের জবা, গন্ধরাজ, কামিনী ও ডালিয়া ফুলের গাছ আছে। এ ছাড়া কাঁঠাল, আমড়া, বরই, শজনে, বিলম্বি ও নিমগাছও লাগিয়েছেন তাঁরা। যত দিন বেঁচে থাকবেন, এই বাগান করে যেতে চান দুই বন্ধু।

মৌলভীবাজার পৌরসভার স্থানীয় কাউন্সিলর আানিছুজ্জামান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ছাইফুল ও তাঁর বন্ধুকে বাগানটি গড়ে তুলতে দেখেছেন। তাঁদের এই উদ্যোগের প্রশংসা করেন তিনি।