বাংলাদেশের প্রাকৃতিক মধুর সবচেয়ে বড় উৎস সুন্দরবন। ঘ্রাণ ও স্বাদে ‘অতুলনীয়’ সুন্দরবনের মধুর রয়েছে বেশ চাহিদা। তবে সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহ বেশ কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। বেঙ্গল টাইগারের রাজ্যে ঢুকে বনের গহিনে হেঁটে হেঁটে মৌমাছির চাক খুঁজে বের করতে হয় মৌয়ালদের। বাঘের আক্রমণে কখনো কখনো প্রাণও যায়। তবু রোজগারের জন্য জীবনবাজি রাখতে হয় তাঁদের।
প্রতিবছরের ১ এপ্রিল থেকে মধু আহরণে মৌয়ালদের অনুমতি (পাস) দেয় বন বিভাগ। এ কার্যক্রম চলে মে মাসের শেষ পর্যন্ত। সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল হাজারো মৌয়াল চলতি মৌসুমে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
মৌয়ালেরা কীভাবে সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহ করেন, সেটি সরেজমিনে দেখার সুযোগ হয় গত মঙ্গলবার (২০ মে)। কয়রা উপজেলার তিন মৌয়াল সাগর মণ্ডল, পরিমল কুমার ও অভিজিৎ মণ্ডলের সঙ্গী হয়ে দুপুরে সুন্দরবন–সংলগ্ন শাকবাড়িয়া নদী থেকে ছোট্ট একটি ডিঙি নৌকায় শুরু হয় যাত্রা।
নৌকার সামনে-পেছনে বসে ছন্দে ছন্দে বইঠা বাইতে থাকেন দুজন। এগোতে থাকে ডিঙি নৌকাটি। শাকবাড়িয়া নদী দিয়ে এঁকেবেঁকে নৌকা চলে যায় গহিন বনের পণ্ডিতখালী খালে। গরান, গেওয়া, বাইন, গোলপাতাসহ নানা জাতের গাছ দুই পাশে। খাল ধরে অল্প কিছুদূর গিয়ে নৌকা থামে। সেখানে একটি গাছে আগে থেকে মৌচাক দেখে রেখেছিলেন মৌয়াল দলের সদস্যরা।
খালের পাড়ে একটি বাইনগাছের সঙ্গে নৌকা বাঁধতে বাঁধতে মৌয়াল অভিজিৎ মণ্ডল বললেন, ‘দেড় মাস ধরে বারবার মধুর চাক ভাঙা হচ্ছে। মৌমাছিরা কিছুতেই স্থির হতে পারছে না। এ জন্য ওরা ভীষণ খ্যাপা। চোখমুখ ঢেকে না নিলে রক্ষা নেই।’ এ কথা বলতে বলতেই মৌমাছির হুল থেকে বাঁচার জন্য মুখমণ্ডল গামছা ও জাল দিয়ে আবৃত করে নেন মৌয়ালেরা। আর মৌমাছি থেকে বাঁচতে তীব্র গরমের মধ্যেও আমি পরে নিয়েছিলাম রেইনকোট।
বনের ভেতর দেখা যায়, মাথা উঁচু করে আছে অসংখ্য শ্বাসমূল। এসব যেন পায়ে না ফুটে যায়, তাই বনে পা ফেলার আগে বিশেষ একধরনের প্লাস্টিকের জুতা পরে নেন সবাই। মৌমাছির চাক কেটে মধু সংগ্রহের জন্য নৌকা থেকে নামিয়ে নেওয়া হয় দা ও একটি হাঁড়ি। হাতে ঝুলিয়ে নেওয়ার জন্য হাঁড়ির মুখে দড়ি বেঁধে নেওয়া হয়।
এরপর নৌকা থেকে বনে নেমে গাছপালার মধ্য দিয়ে হেঁটে তিন মৌয়ালের সঙ্গে এগোতে থাকি। ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে মৌয়ালদের অনুসরণ করে হাঁটাও বেশ কঠিন। কারণ, চারদিকে শ্বাসমূল, আঠালো কাদা আর গাছপালাগুলো এতটাই ঘন যে কয়েক হাত দূরের কিছুও দেখা যায় না। এর মধ্য দিয়ে কাদাপানির খানিকটা পথ হেঁটে একটি বড় বাইনগাছের তলায় গিয়ে থামলেন তাঁরা। সবার চোখ গাছের ডালের দিকে। মৌয়াল সাগর মণ্ডল আঙুল উঁচিয়ে ডালের দিকে ইশারা করে কিছুটা হতাশার সুরে বললেন, ‘ওইখানেই তো ছিল মৌচাক। কিন্তু আমরা আসার আগে অন্য কোনো দল কেটে নিয়ে গেছে মনে হয়।’
পরিমল কুমার বলে ওঠেন, ‘যা গেছে তা নিয়ে সময় নষ্ট না করে চলেন সবাই মিলে একটা ছাটা দিই।’ বনের মধ্যে হেঁটে হেঁটে মৌচাক খোঁজাকে মৌয়ালদের ভাষায় ‘ছাটা দেওয়া’ বলে। তিনজন তিন দিকে হেঁটে মৌচাক খুঁজতে শুরু করেন। কেউ যাতে দলছুট না হন, সে জন্য একটু পর পর মুখ দিয়ে ‘কুউউউ’ শব্দ করা হয়। সেই শব্দ শুনে পাল্টা শব্দের মাধ্যমে বাকিরা তাঁদের গতিবিধি জানান দেন। এভাবে চাক খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত বনের ভেতর হাঁটতে থাকেন তাঁরা।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ছোটখাটো গেওয়াগাছের ডালে একটি চাক খুঁজে পেলেন মৌয়াল সাগর মণ্ডল। মৌচাকের দেখা মিলতেই সবাই আনন্দিত। মৌয়াল পরিমল সতর্ক করে দিলেন, যাতে কেউ উচ্চ শব্দে কথা না বলি, তাতে মৌমাছির আক্রমণের আশঙ্কা বেড়ে যাবে।
মৌয়ালরা আগুন দিয়ে ধোঁয়া তৈরির জন্য শুকনা পাতা জোগাড় করতে লাগলেন। হুদো নামের একধরনের লম্বাটে শুকনা পাতাওয়ালা গাছ আর ওপরের দিকে কাঁচা পাতা দিয়ে একটি মোড়কের মতো তৈরি করা হলো। একে তাঁরা ‘কাড়ু’ বলে থাকেন। কাড়ুতে আগুন দিতেই ধোঁয়ায় আচ্ছাদিত হয়ে গেল এলাকা।
এরপর কাড়ু হাতে নিয়ে সামনে সামনে চললেন সাগর মণ্ডল। তাঁর পেছনে পরিমলের হাতে দা আর কাঁধের সঙ্গে ঝোলানো মধু রাখার হাঁড়ি। মৌচাকের কাছে গিয়ে কাড়ুর জ্বলন্ত মুখ নিচের দিকে ধরার সঙ্গে সঙ্গে ধোঁয়ার মাত্রা বেড়ে পৌঁছে যায় মৌচাকে। ধোঁয়ার আঁচে শোঁ শোঁ শব্দ করে মৌমাছিরা চাক ছেড়ে পালাতে শুরু করলে মধুসমৃদ্ধ চাক ফুটে ওঠে চোখের সামনে।
পুরো চাকটাতে তিনটা ভাগ স্পষ্ট। এক ভাগে মৌমাছির বাসা, আরেক ভাগে মধু। মধুর নিচে থাকে আরেকটা অংশ, যাকে গুটলি (ফুলের পরাগরেণু) বলে। সেই অংশটাই প্রথমে কেটে ফেলে দিলেন মৌয়াল পরিমল। এরপর ফাঁকা হয়ে যাওয়া চাকের মধুর অংশটি দা দিয়ে কেটে হাঁড়ির মধ্যে রাখেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই কাজ শেষ। মধুর হাঁড়ি আর কাড়ু নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটে যাই সবাই। আর মৌমাছিগুলো আবার চাকে ফিরে যেতে শুরু করে।
অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গায় এসে চাক চিপে মধু ও মোম আলাদা করতে করতে মৌয়াল পরিমল কুমার বললেন, ‘আমরা শুধু মৌচাকের মধুর অংশটাই কাটি। ভুলেও মৌমাছির বাসার অংশ কাটি না। চাক একেবারে কেটে ফেললে ওই চাকে আর কখনোই মৌমাছি বসার সম্ভাবনা থাকে না। আর যদি বাসাটা রেখে দেওয়া হয়, তাহলে সেই চাকে আবারও মৌমাছি মধু সংগ্রহ করে। দুই সপ্তাহ পরে সেই চাক আবার কাটার উপযোগী হয়।’
সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের প্রতিটি মুহূর্ত রোমাঞ্চকর। গহিন এই বনের ভেতর থেকে বাঘ, বিষধর সাপ আর পায়ের নিচের ছোট-বড় শ্বাসমূলকে উপেক্ষা করে চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি গাছের গায়ে বসা মৌমাছির বাসায় নিবিষ্ট করে হাঁটতে হয়। মনে বাঘের ভয় থাকলেও ইতিউতি তাকানোর সুযোগ নেই। আর এতেই সব সময় গা ছমছম করা শিরশিরে একটা অনুভূতির স্রোত বয়ে যায় শরীরে।
আর দেরি না করে ফিরতি পথ ধরি আমরা। পণ্ডিতখালী খাল থেকে বেরিয়ে শাকবাড়িয়া নদীতে এসে দেখি, নদী পাড়ে যেখানে তিন ঘণ্টা আগেও শুকনা ছিল, জোয়ারের তোড়ে সেখানেও হাঁটুপানি। নদী থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নৌকার পাটাতনে রাখা হাঁড়িটির মধ্যে টাটকা মধু দেখেই মনটা জুড়িয়ে যায়। হাতের তালুতে কিছুটা মধু নিয়ে মুখে দিতেই মিষ্টিতে ভরে যায় পুরো মুখ।
লোকালয়ে ফিরে এ অভিজ্ঞতার গল্প হয় উপকূল ও সুন্দরবন সংরক্ষণ আন্দোলনের সদস্যসচিব মো. সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বললেন, সম্প্রতি সুন্দরবনের মধুর জিআই সনদ দেওয়া হয়েছে। এতে বিশ্বে বাংলাদেশের সুন্দরবনের মধুর একটা নতুন ব্র্যান্ডিং হবে। কিন্তু সে জন্য প্রয়োজন মধুর গুণগত মান নিশ্চিত করা এবং টেকসই মধু সংগ্রহ নীতিমালা, যাতে মৌয়াল ও সুন্দরবন দুটিই উপকৃত হবে।