সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দারের সাক্ষাৎকার

জেলিফিশ, ডলফিন, কাছিম মারা যাচ্ছে মাছ ধরার জালে আটকা পড়ে

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে কয়েক দিন ধরে ভেসে আসছে বিপুলসংখ্যক জেলিফিশ। পাশাপাশি ভেসে আসছে মরা ডলফিন, মা কাছিমও। গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কয়েক মাসে তিন দফায় কয়েক হাজার জেলিফিশ ভেসে এসেছিল। ওই সময় জোয়ারে ভেসে আসে তিমি, ডলফিন, কাছিমসহ ছোট প্রজাতির বিপুল মাছ। হঠাৎ হঠাৎ সামুদ্রিক প্রাণীর মৃত্যু এবং সৈকতে ভেসে আসার দৃশ্য দেখে স্থানীয় লোকজন ও পরিবেশবিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এমনটি হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ও সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কক্সবাজারে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক আব্দুল কুদ্দুস।

বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ও সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: সৈকতে এত মরা জেলিফিশ, ডলফিন, কাছিম ভেসে আসছে কেন?

সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার: তাপমাত্রা ও পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেলে জেলিফিশের বংশবিস্তার ঘটে ব্যাপকভাবে। যৌন ও অযৌন—দুই পদ্ধতিতে বংশবিস্তার ঘটে। জেলিফিশ স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটতে পারেনা। দল বেঁধে চলার সময় স্রোতের টানে একত্রে ভেসে জালে আটকা পড়ে মারা যায়। জেলেরা সেটা সাগরে ফেলে দেয়। পরে জোয়ারের পানিতে জেলিফিশ সৈকতে ভেসে আসে। জেলিফিশের আয়ুষ্কালও কম, মাত্র এক থেকে তিন বছর। শরীরও খুব নরম। মরা জেলিফিশ বেশির ভাগ সাগরে বিলুপ্ত হয়ে যায়, অল্প কিছু ভেসে আসে সৈকতে।

আর কাছিমের মৃত্যু হচ্ছে মাছ ধরার জালে আটকা পড়ে। কিছু কাছিম ডিম পাড়ার সময় সৈকতে কুকুরের কামড়ে মারা যায়। গত তিন মাসে সৈকতে ভেসে আসা ২০টির বেশি মরা কাছিম পরীক্ষা করে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। সব কটি কাছিম অলিভ রিডলে প্রজাতির। এ প্রজাতির কাছিমের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যে জায়গাতে ডিম পাড়ে, তার বাচ্চাগুলো ১৯-২০ বছর পর প্রাপ্ত বয়সে সে জায়গাতেই ডিম পাড়তে আসে। আমাদের উপকূলে প্রচুর টানাজাল, বিহিন্দিজাল, কারেন্টজাল পুঁতে রাখা হয়। এসব জালে আটকা পড়েই বেশির ভাগ কাছিমের মৃত্যু হচ্ছে।

ডলফিনের ক্ষেত্রেও তা-ই। সম্প্রতি কক্সবাজার সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে ইরাবতী প্রজাতির দুটো মরা ডলফিন ভেসে এসেছে। ডলফিনের শরীরেও আঘাতের চিহ্ন ছিল। ডলফিনগুলো ইরাবতী প্রজাতির। আর তিমির মৃত্যু হচ্ছে দিগ্ভ্রান্ত হয়ে অথবা অন্য কোনো কারণে। সম্পর্ক ছিন্ন হলেও তিমির মৃত্যু হতে পারে। মিয়ানমার সীমান্তে তেল-গ্যাসের অনুসন্ধান চলে, বিকট শব্দ তিমিকে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগে বিঘ্ন ঘটায়। তখন দিগ্ভ্রান্ত হয়ে একাকী হয়ে যায় তিমি।

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের কলাতলী পয়েন্টে গত মঙ্গলবার বিকেলের জোয়ারে ভেসে আসা মরা জেলিফিশ
ছবি: প্রথম আলো
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: অনেকের দাবি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এমনটা হচ্ছে।

সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার: সম্ভবত না। আমাদের বঙ্গোপসাগর এতই ডায়নামিক যে এখানে দিনে দুবার জোয়ার-ভাটা হয়। দূষণ হলে দীর্ঘস্থায়ী হয় না। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কিংবা পরিবেশ দূষণের কারণে মারা গেলে সব প্রজাতির মাছের মৃত্যু একসঙ্গে হতো। দূষণ হলে প্রথম দিকে নরম জাতের মাছ লইট্যা, চিংড়ি মারা যেত। কিন্তু এ জাতের মাছ এখনো ভেসে আসতে দেখা যায়নি।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: সমুদ্রসম্পদ নিয়ে অনেক দিন গবেষণা হচ্ছে না। কারণ কী?

সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার: দেশে সমুদ্র গবেষণার উপযোগী জাহাজ নেই। মিন সন্ধানী নামের যে জাহাজ মৎস্য বিভাগের আছে, তা দিয়ে নদীর মোহনা ও উপকূলে গবেষণা করা যায়। এখন সমুদ্র গবেষণার জন্য ৩২ মিটার লম্বা একটি জাহাজ খুলনা শিপইয়ার্ডে প্রস্তুত করা হচ্ছে। ১০০ মিটার লম্বা আরও একটি জাহাজ কেনার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি পাওয়া গেছে। আশা করছি, এ বছরের মধ্যে জাহাজ পেয়ে যাব। তখন উপকূল এবং গভীর সমুদ্রে গবেষণা চালানো সম্ভব হবে।

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে গত বুধবার বিকেলের জোয়ারে ভেসে আসা মৃত ডলফিন
ছবি: সংগৃহীত
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: কক্সবাজারে এখন আপনারা কী করছেন?

সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার: তিন বছর ধরে আমরা সমুদ্র নিয়ে গবেষণা করছি। যেহেতু আমাদের জাহাজ নেই, সাধারণত আমরা ট্রলার ভাড়া করে গবেষণাগুলো করছি। এর মধ্যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আছে। ইতিমধ্যে আমরা সেন্ট মার্টিন থেকে শুরু করে ফেনী নদী পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্র ওশানোগ্রাফি ডেটা সংগ্রহ করেছি। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের মাইক্রো প্লাস্টিকের দূষণের মাত্রা এবং মাত্রার মানচিত্র অঙ্কন করেছি। কী কারণে দ্বীপের ক্ষতি হচ্ছে, সেটাও নির্ণয় করেছি। দ্বীপের যত প্রবাল-শৈবাল আছে, সব কটি চিহ্নিত করেছি এবং প্রবাল পুনরুদ্ধারের জন্য কার্যক্রম হাতে নিতে যাচ্ছি। সেন্ট মার্টিন থেকে কুতুবদিয়া পর্যন্ত সামুদ্রিক শেওলার (সি উইডস) চাষ কোথায় হবে, সেসব জায়গা চিহ্নিত করেছি।

ইতিমধ্যে মহেশখালীতে সি-উইডসের পরীক্ষামূলক চাষ শুরু করেছি। সোনাদিয়াতে দূষণের কারণ চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। তা ছাড়া উপকূলের কোথায় কোথায় খনিজ বালু রয়েছে, তা-ও চিহ্নিত করা হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে যে পরিমাণ মাছ আছে, তা শনাক্ত করে সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষার্থী ওশানোগ্রাফ নিয়ে গবেষণা করেন, তাঁদের জন্য আমাদের ল্যাব আছে, তাঁদের গবেষণার কাজে সব সময় আমরা সহায়তা দিচ্ছি। তা ছাড়া সমুদ্র বিষয়ে যে-কেউ গবেষণা করতে চাইলে আমাদের গবেষণাগার উন্মুক্ত আছে। সেখানে রয়েছে ডেটা সেন্টার। এখন প্রায় ১০০ বছরের ডেটা সংগ্রহ হয়েছে। আরও ডেটা সংগ্রহ হচ্ছে। এর ফলে পটেনশিয়াল মৎস্য জোন নির্ধারণ করতে পারব। জেলেদের আগাম বার্তা দেওয়া সম্ভব হবে, সাগরের কোন এলাকায় গেলে মাছ পাওয়া যাবে।

কক্সবাজার সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটে মরা কাছিমের পরীক্ষা করেন সমুদ্রবিজ্ঞানীরা। ছবিটি সম্প্রতি তোলা
ছবি: প্রথম আলো
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: এ মুহূর্তে সৈকত ও সমুদ্র কোনোটাই প্রাণীদের জন্য নিরাপদ নয়। এ ক্ষেত্রে করার কিছু নেই?

সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার: বিদেশি ট্রলিং, অনিয়ন্ত্রিত ও নিষিদ্ধ জালে আটকা পড়ে যেমন জেলিফিশ, ডলফিন, কাছিম মারা যাচ্ছে, তেমনি সৈকতেও বিচ বাইকের অনিয়ন্ত্রিত চলাচল ও মানুষের নিষ্ঠুরতায় লাল কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুকসহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। বিচ বাইকের কারণে সৈকতের ডেইল (ঢিবি) ও বালুচর নিশ্চিহ্ন হচ্ছে। ডেইল নষ্ট হওয়ায় কাছিম ডিম পাড়তে আসছে না। ডিম পাড়ার জায়গাতে গড়ে উঠছে হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট। বালিয়াড়ির সাগরলতা, কেয়া, নিসিন্দাসহ ছোট গুল্ম গাছগুলো ধ্বংস করছে বিচ বাইক। সৈকত সুরক্ষিত রাখতে হলে বিচ বাইকের চলাচল সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে। সমুদ্রের পানিতে জলযান জেডস্কি, স্পিডবোটের চলাচলও নির্দিষ্ট জায়গাতে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। পর্যটকের যত্রতত্র চলাচল নিয়ন্ত্রণ, রাতের বেলায় আলোকসজ্জা, হইচই-বারবিকিউ বন্ধ করতে হবে। সৈকতকে ঘিরে উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা গ্রহণের আগে সমুদ্রবিজ্ঞানীদের পরামর্শ নিতে হবে।