জালিয়াতি করে ‘মঈন’ নাম নিয়ে ২২ বছর কারারক্ষীর চাকরি করেছেন তাজুল

প্রতারণার মাধ্যমে ২২ বছর কারারক্ষীর চাকরি করা তাজুল ইসলাম। আজ শুক্রবার বেলা ১১টায় কুমিল্লা নগরের শাকতলা র‌্যাব কার্যালয়ে
ছবি: প্রথম আলো

তাঁর নাম তাজুল ইসলাম (৪২)। বাবার নাম প্রয়াত কালা মিয়া ও মায়ের নাম ফিরোজা বেগম। অথচ ২২ বছর ধরে তিনি কারারক্ষীর চাকরিতে ছিলেন ‘মঈন উদ্দিন খান’ নামে। এমন একটি স্পর্শকাতর পদে তিনি ভুয়া পরিচয় দিয়ে ও তথ্য গোপন করে চাকরি নিয়েছিলেন। ঘটনাটি ২২ বছর পর জানতে পারে কারা কর্তৃপক্ষ। এদিকে তাজুল ইসলামও বিপদ আঁচ করতে পেরে কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়ে আত্মগোপন করেন। অবশেষে র‌্যাবের সহায়তায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে র‍্যাব-১১ ক্রাইম প্রিভেনশন কোম্পানি-২ কুমিল্লার সদস্যরা প্রতারণার মাধ্যমে কারারক্ষীর চাকরি করা তাজুল ইসলামকে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া বাজার থেকে গ্রেপ্তার করেন। গ্রেপ্তারের সময় তাঁর কাছ থেকে তিন সেট কারারক্ষী ইউনিফর্ম, একটি জ্যাকেট, একটি রেইনকোট ও ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) জব্দ করা হয়। আজ শুক্রবার সকাল ১০টায় কুমিল্লা নগরের শাকতলা র‍্যাব কোম্পানি দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কমান্ডার মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন এসব তথ্য জানান।

তাজুল ইসলামের বাড়ি কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার শশীদল ইউনিয়নের দক্ষিণ শশীদল গ্রামে। যে মঈন উদ্দিন খানের পরিচয়ে তাজুল প্রায় দুই যুগ সরকারি চাকরি করেছেন, সেই মঈন উদ্দিন খানের বাড়ি হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার শাহজাহানপুর গ্রামে। মঈনের বাবার নাম নুর উদ্দিন খান। আসলে কারারক্ষীর চাকরি পাওয়ার কথা ছিল এই মঈনেরই। ২০০১ সালে কারারক্ষী পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে মঈন ও তাজুল দুজনেই আবেদন করেছিলেন। তাজুল পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হন। আর মঈন কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে শারীরিক ফিটনেস, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। বলা হয়েছিল, যাঁরা চাকরিতে টিকবেন, তাঁদের নিয়োগপত্র স্থায়ী ঠিকানায় পাঠানো হবে। তাজুল তখন জালিয়াতির মাধ্যমে চাকরি পাওয়ার পরিকল্পনা আঁটেন।

২০০১ সালে কারারক্ষী পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে মঈন ও তাজুল দুজনেই আবেদন করেছিলেন। তাজুল পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হন। আর মঈন কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে শারীরিক ফিটনেস, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন।

র‍্যাব অধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন জানান, তাজুল তাঁর দুই সহযোগীকে নিয়ে মঈনের বাড়িতে যান। তাঁরা নিজেদের কারা কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলে দাবি করেন। তাঁরা মঈনের কাছে, ১০ লাখ টাকা দাবি করেন। অন্যথায় নিয়োগ হবে না বলে জানান। তখন মঈন বলেন, ঘুষ দিয়ে তিনি চাকরি করবেন না। তাজুল ও তাঁর সহযোগীরা এরপর চলে আসেন।

পরে কুমিল্লার তাজুল ইসলাম হবিগঞ্জের মঈনের নাম ও ঠিকানা ব্যবহার করে কারারক্ষী পদে চাকরি নেন। ২০১৫ সালে জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতনপ্রাপ্তির জন্য এনআইডির দরকার হয়। তখন তাজুল কারারক্ষী পদে উত্তীর্ণ মঈন খানের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে একটি আইডি কার্ড তৈরি করেন। পরে ২০২০ সালে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ে, সিলেট বিভাগে ২০০ জন কারারক্ষী বেআইনিভাবে কাজ করছেন। সিলেটের ওই ২০০ জনের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হয়। তখন হবিগঞ্জের মাধবপুরে মঈন উদ্দিন খানের তথ্যও যাচাই করা হয়।

একপর্যায়ে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের উপমহাপরিদর্শক মাধবপুর উপজেলার শাহজাহানপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানের কাছে একটি চিঠি দেন। এতে কারারক্ষী মঈন উদ্দন খান সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা কি না, তা জানতে চান। ইউপি চেয়ারম্যান জবাবে জানান, মঈন উদ্দিন খান কারারক্ষী নন। তিনি তাঁদের এলাকার ছেলে, ওষুধ ব্যবসায়ী।

কারা কর্তৃপক্ষের এসব তৎপরতা জানতে পেরে তাজুল ইসলাম ২০২১ সালের ১৫-২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছুটি নেন। এর পর থেকে তিনি আর যোগদান করেননি।

এদিকে মঈন উদ্দিন খান তাঁর চাকরিবঞ্চিত হওয়ার বিষয়টি জানতে পেরে গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর তাঁকে চাকরি দেওয়ার জন্য কারা কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন। একপর্যায়ে চাকরি না পেয়ে তিন আদালতের দ্বারস্থ হন। এরপর কারা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করে। ২০২১ সালের ২০ নভেম্বর প্রতারক তাজুল ইসলামকে তদন্ত কমিটি ডাকে। কিন্তু তদন্ত কমিটির সামনে হাজির হননি তাজুল। প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে চাকরি করার অভিযোগে গত ৪ আগস্ট সিলেটের জালালাবাদ থানায় মামলা করে কারা কর্তৃপক্ষ। পরে কারা কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে র‍্যাবের সহযোগিতা কামনা করে। ১২ জানুয়ারি তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে তাজুলের অবস্থান শনাক্ত করে তাঁকে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া বাজার থেকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব।

এই জালিয়াতির বিষয়ে র‍্যাব দপ্তরে তাজুল ইসলামকে গণমাধ্যমকর্মীরা প্রশ্ন করলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন বলেন, তাজুলকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করা হবে।