বন থেকে ছন কুড়িয়ে চলে বৃদ্ধের সংসার

বন থেকে ছন সংগ্রহ করে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন আক্কাস আলী শেখ। গত রোববার গাজীপুরের শ্রীপুরের রাজাবাড়ি ইউনিয়নের বিন্দুবাড়ি গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

বয়স ৮০ বছরের বেশি।  দৃঢ় মনোবল সঙ্গী করে ১৫ বছর ধরে বনে ঘুরে ঘুরে ছন কুড়িয়ে ঝাড়ু বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি।

এই বৃদ্ধের নাম আক্কাস আলী শেখ। গ্রামের সবার কাছে তিনি ‘আক্কে’ নামে পরিচিত। তাঁর বাড়ি গাজীপুরের শ্রীপুরের রাজাবাড়ি ইউনিয়নের বিন্দুবাড়ি গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের শিকদার শেখের ছেলে। ছয় সন্তানের জনক। তিন ছেলের মধ্যে একজন অটোরিকশা চালান, অন্য দুজন দিনমজুর। মেয়েদের মধ্যে তিনজনই প্রতিবন্ধী। এক মেয়ে সম্প্রতি অসুস্থতায় মারা গেছেন। তবে ছেলেরা অন্যত্র থাকেন। তিনি তাঁর স্ত্রী ও দুই প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে বসবাস করছেন।

গত রোববার শ্রীপুরের বিন্দুবাড়ি গ্রামে শাল-গজারির গভীর অরণ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন আক্কাস আলী। মাথায় এক আটি কাঁচা ছন। তাঁকে থামিয়ে গাছের ছায়ায় বসে জানা হলো তাঁর দৈনন্দিন কাজের আদ্যপান্ত। তিনি জানান, ছেলেরা নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। স্ত্রী গৃহিণী। তাঁর সংসারে তিনিই একমাত্র উপার্জনক্ষম। সংসার চালাতে বন থেকে ছন সংগ্রহ করে ১৫ বছর ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ছন শুকিয়ে সেগুলো দিয়ে নিজেই ঝাড়ু তৈরি করেন বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করেন। ছন দিয়ে কীভাবে ঝাড়ু তৈরি করেন তা দেখাতে তিনি তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ি বলতে কোনোরকমে টিন দিয়ে ছাওয়া একটি কক্ষ। সেখানেই তাঁদের চারজনের বসতি। হাতে–কলমে দেখালেন শুকনা ছন দিয়ে ঝাড়ু তৈরির কৌশল।

আক্কাস আলী শেখ বলেন, বন ও বিভিন্ন ফসলি জমির পাশে ছন এমনিতেই জন্মায়। তিনি ছনগুলো কেটে আঁটি বেঁধে বাড়িতে নিয়ে আসেন। এরপর মাপমতো ছনের আগা ছেঁটে প্লাস্টিক দিয়ে বেঁধে ঝাড়ু তৈরি করেন। এসব ঝাড়ু খুচরায় ৪০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি করতে পারেন। তবে বিভিন্ন দোকানে পাইকারি বিক্রির ক্ষেত্রে তিনি দাম পান ২৫–৩০ টাকা। তিনি জানান, প্রতিদিন ৮ থেকে ১০টি ঝাড়ু তৈরি করার মতো ছন তুলতে পারেন। প্রতি মাসে ঝাড়ু বানিয়ে বিক্রি করে তাঁর আয় হয় পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা।

আক্কাস আলী বলেন, অসুস্থতার কারণে তাঁর বাঁ হাতের আঙুল কিছুটা আড়ষ্ট। ওই হাতে কাজ করতে শক্তি কম পান। হাতের আঙুল সব কটি অগোছালো। অসচ্ছল অবস্থায় থেকেও তিনি হাতের চিকিৎসা করিয়েছেন। টাকা খরচ হলেও হাত আর ভালো হয়নি। তিনি আরও জানান, প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বিন্দুবাড়ি, সাতখামাইর, পুষাইদসহ বিভিন্ন এলাকায় শালবনের ভেতরে ঘুরে বেড়ান। এসব বনের গাছের ফাঁকে ফাঁকে ছন পাওয়া যায়। বছর পাঁচেক ধরে বনজুড়ে ছনের পরিমাণ কমে গেছে বলে জানান তিনি। এ ছাড়া বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিকের তৈরি ঝাড়ু বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় ছনের ঝাড়ুর চাহিদাও কমে গেছে বলে জানিয়েছেন।

আক্কাস আলী দুঃখ করে বলেন, গ্রীষ্ম মৌসুমে শালবনের ভেতরে অনেকে আগুন ধরিয়ে দেন। এসব আগুনে বনের ভেতরে থাকা ছন ও ছোট গাছপালা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। বনে এমন আগুন জ্বলতে দেখলে তাঁর দুঃখ হয়।

স্থানীয় কলেজশিক্ষক মিসকাত রাসেল প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্রাম নেওয়ার বয়সে আক্কে (আক্কাস আলী শেখ) জীবনসংগ্রামে কষ্ট করে টিকে আছেন। তাঁর জীবিকা বননির্ভর। এত কষ্টের পরও তিনি ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে কথা বলেন। মনে হয়, যেন জীবন নিয়ে তাঁর কোনো অভিযোগ নেই।