গাছি নুর ইসলাম, ৩ দশক ধরে রস সংগ্রহ করেন যিনি

রস সংগ্রহের জন্য খেঁজুরগাছ কাটছেন গাছি নুর ইসলাম। ছবিটি গত শনিবার বিকেলে উপজেলার উত্তর চর সাহাভিকারী এলাকা থেকে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

শরীরে প্যাঁচানো দড়ি। কোমরের পেছনে বাঁশের তৈরি ঝুড়ি। ভেতরে বাটালি, হাঁসুয়া ও কাস্তে। এসব নিয়েই তরতর করে খেজুরগাছ বেয়ে উঠছেন গাছি নুর ইসলাম (৫০)। শীত এলেই ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার উত্তর চর সাহাভিকারী এলাকায় খেজুরগাছ প্রস্তুত করতে দেখা যায় নুর ইসলামকে। তিন দশক ধরে গাছ প্রস্তুত ও রস সংগ্রহের কাজ করছেন তিনি।

গত শনিবার দুপুরে নুর ইসলাম শোনালেন তাঁর গল্প। শীত বাড়তে থাকায় গত দুই সপ্তাহ ধরে রস সংগ্রহের জন্য গাছির কাজ শুরু করেছেন তিনি। পুরো শীত মৌসুমজুড়ে চলবে রস সংগ্রহ ও গাছ কাটার কাজ।

হেমন্তের শেষ থেকে বসন্তের শুরু পর্যন্ত পুরো মৌসুম গাছির কাজ করেন নুর ইসলাম। মৌসুমের চার মাসে প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা আয় হয় তাঁর। বছরের অন্য মাসগুলো তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ও কাজীরহাট বাজারে দা-ছুরিতে শাণ দেওয়ার কাজ করেন। স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। ছেলেমেয়েরা স্কুলে ও মাদ্রাসায় লেখাপড়া করছে।

গাছি নুর ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘খেজুরগাছ থেকে পুরো দমে রস সংগ্রহ শুরু হলে কাজে একজন শ্রমিক নিই। দুজন মিলে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত গাছ কেটে হাঁড়ি ঝুলিয়ে দিই। সারা রাত রস পড়তে থাকে। ভোর থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত রসের হাঁড়ি নামাই। কিছু রস বিক্রি হয়। বাকি রস দিয়ে গুড় তৈরি করে বিক্রি করি।’

নুর ইসলামের জন্মস্থান নোয়াখালীর হাতিয়ায়। ২৫ বছর আগে নদীভাঙনে তাঁর বসতবাড়ি হারিয়ে যায়। সে সময় হাতিয়া থেকে এসে উত্তর চর সাহাভিকারী এলাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি। এরপর বিয়ে করে এখানেই স্থায়ী হয়ে যান। বাপ-দাদার হাত ধরেই এই গাছি পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন তিনি।

উত্তর চর সাহাভিকারী এলাকার বিভিন্ন সড়ক ও বাড়ির আঙিনায় অন্তত শতাধিক খেজুরগাছ আছে। রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত করতে গাছপ্রতি ১২০ থেকে ১৫০ টাকা নেন তিনি। আবার নিজেও গ্রামে-গঞ্জের ৭০ থেকে ৮০টি খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ করেন। সেই রস থেকে গুড় তৈরি করে বিক্রি করেন। আবার রসও বিক্রি হয়। প্রতিদিন ভোর থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত উপজেলার কাজীরহাট বাজার এলাকায় রস বিক্রি করেন নুর ইসলাম।

উপজেলার উত্তর চর সাহাভিকারী এলাকার বাসিন্দা মাইন উদ্দিন বলেন, তাঁদের ১৫টি খেজুরগাছ রয়েছে। ২০ বছর ধরে শীত মৌসুমে নুর ইসলাম তাঁদের গাছগুলো কেটে রস আহরণের জন্য প্রস্তুত করেন। গাছ থেকে রস নামিয়ে সপ্তাহে চার দিন তিনি নিয়ে যান। তিন দিন বা দুই দিন রস তাঁদের দেন। এতে উভয়ের কোনো টাকা খরচ হয় না।

নুর ইসলাম আক্ষেপ করে বলেন, ‘বর্তমানে যে হারে খেজুরগাছ কমে যাচ্ছে, হয়তো একসময় এলাকা থেকে খেজুরগাছ হারিয়ে যাবে। তখন আমাদের মতো গাছিরা উপার্জন হারাবে। তাই তালগাছের মতো বেশি করে খেজুরগাছ লাগানো দরকার।’