রাস্তা ঝাড়ু দিয়েই শান্তি ভুবনের শান্তি

১৫ বছর ধরে প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করছেন শান্তি ভুবন দাস। ভোর থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত স্বেচ্ছায় কাজটি করে যাচ্ছেন তিনি। সম্প্রতি রাজবাড়ী শহরের দক্ষিণ ভবানীপুর মাস্টারপাড়ায়
ছবি: এজাজ আহম্মেদ

পাড়ার গলির রাস্তাটার কোথাও কোনো ময়লা–আবর্জনা নেই। গাছের একটি পাতা পর্যন্ত পড়ে নেই কারও বাড়ির সামনে। ছোটখাটো ঝোপঝাড়; তা–ও পরিষ্কার করে কাটা। সকালে ঘুম ভেঙে ঝকঝকে উঠান, রাস্তাঘাট দেখে পাড়ার লোকের ঠোঁটে হাসি ফোটে। বছরের পর বছর ধরে এমন পরিবেশই দেখে অভ্যস্ত রাজবাড়ী শহরের দক্ষিণ ভবানীপুরের মাস্টারপাড়ার বাসিন্দারা।

নাহ্, কোনো পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ এটি নয়। যিনি এই কাজ করেন, তিনি অবসরপ্রাপ্ত সরকারি এক চাকরিজীবী। কিছু পাওয়ার আশায় নয়। নেহাত নিজের ভালো লাগা থেকে ১৪ বছর ধরে কাজটি করে চলেছেন। রোজ ভোরে উঠে প্রায় এক কিলোমিটার সড়ক ঝাড়ু দেন। তাঁর নাম শান্তি ভুবন দাস, বয়স ৭৩ বছর।

শান্তি ভুবন দাস
ছবি: প্রথম আলো

একজন বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষের এমন নিরলস কর্মনিষ্ঠা দেখে পাড়ার লোক তো বটেই, শহরের মান্যগণ্য অনেকেই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। কেউ কেউ বলেছেন, এটি মহৎ উদ্যোগ। তিনি এলাকার, সমাজের, দেশের–দশের গর্ব। লোকজন তাঁর মতো পথে নামলে দেশটাই দূষণমুক্ত আর শুদ্ধ হয়ে উঠত—এমন মন্তব্য করেছেন রাজবাড়ী সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) অধ্যাপক মো. নুরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। সরকারি চাকরি শেষে অবসর নিয়েছেন। নিজের ইচ্ছায় এই বয়সেও প্রতিদিন রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছেন। তাঁর মতো সবাই উদ্যোগী হলে, সচেতন হলে আমাদের পরিবেশ, দেশ পরিচ্ছন্ন হতো। আমাদের প্রত্যেকের উচিত, নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভালো কাজের সঙ্গী হওয়া।’

যেভাবে কাজটা করেন

রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মহাসড়কের রত্না কমিউনিটি সেন্টারের দক্ষিণ পাশ দিয়ে যে সড়ক, সেটিই মাস্টারপাড়ায় গেছে। গত এক মাসে বেশ কয়েক দিন সকালে ওই সড়কে গিয়ে দেখা যায়, সকাল সাতটা বাজতে না বাজতেই পুরো রাস্তা ঝকঝকে–তকতকে।

শান্তি ভুবন বলেন, ‘২০০৭ সাল থেকে বাড়ির সামনের সড়ক পরিষ্কার করতে শুরু করি। এরপর সিদ্ধান্ত নিই, অবসরে গেলে প্রতিদিন সড়ক পরিষ্কার করব। ২০০৯ সালের প্রথম দিন থেকেই এ কাজ শুরু করি। প্রতিদিন ভোর চারটায় ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে পড়ি। রত্না কমিউনিটি সেন্টারের মোড় থেকে শুরু করে সড়কের শেষ মাথার শ্যামল মণ্ডলের বাড়ি পর্যন্ত ঝাড়ু দিই। এরপর প্রয়াত সাংবাদিক হিমাংশু সাহার বাড়ি থেকে ভক্ত স্যারের বাড়ি পর্যন্ত যে সড়ক, সেটি; উত্তম কুমার সরকারের বাড়ি থেকে বুদ্ধুদের বাড়ির গলি পর্যন্ত পরিষ্কার করি। এসব আবর্জনা কয়েকটি স্থানে জড়ো করে রাখি। এরপর তা আগুনে পুড়িয়ে ফেলি।’ পুরো কাজটা করতে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা লাগে।

সড়কের আশপাশের আগাছাও পরিষ্কার করেন শান্তি ভুবন। কোনো কিছুতে পানি জমে থাকলে কয়েক দিন পরপর তা পরিষ্কার করেন। তিনি আরও বলেন, ‘সড়ক পরিষ্কার করে সকাল সাতটার দিকে বাড়িতে যাই। বাড়িতে গিয়ে স্নান করে পূজা-অর্চনা করি। এরপর সকালের নাশতা সারি। সকাল ১০টার দিকে আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যাই।’

সড়কের আশপাশের আগাছাও পরিষ্কার করেন শান্তি ভুবন
ছবি: প্রথম আলো

অন্যরা যা বলেন

শান্তি ভুবন দাসকে নিয়ে গর্ব করলেন প্রতিবেশী ও বেসরকারি সংস্থা ভিপিকেএ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক হাফিজ আল আসাদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিনি আমার বাবার বন্ধু। আমার বাবাও পানি উন্নয়ন বোর্ডে (পাউবো) চাকরি করতেন। আগে ভাবতাম, প্রতিদিন পৌরসভার লোকজন সড়ক পরিষ্কার করে রাখে। একদিন সকালে দেখি, শান্তি কাকু সড়ক ঝাঁট দিচ্ছেন। এরপর আরও কয়েক দিন দেখেছি এ দৃশ্য। এরপর কাকুর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, নিজের ভালো লাগা থেকেই তিনি এটা করেন।’

শান্তি ভুবনের কাজটিকে দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখেন স্থানীয় বাসিন্দা ও বারুগ্রাম উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কনা রানী দাস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তাঁকে মামা বলে ডাকি। তিনি কোনো কাজকে ছোট মনে করেন না। প্রতিদিন সকালে উঠে সড়ক ঝাড়ু দেন। প্রতিবেশীদের বাড়ির প্রাচীরে জমে থাকা আগাছা পরিষ্কার করেন। পাড়ার সড়কের পাশের যেসব বাড়িতে বয়স্ক লোকজন থাকেন, সেগুলোর উঠানও বাদ যায় না। এ কারণে আমাদের মশা-মাছির উপদ্রব নেই।’
শান্তি ভুবন নিজের মতো থাকেন। কারও সঙ্গে কোনো ঝুট–ঝামেলা নেই। বড়পুল এলাকার বাসিন্দা আইনজীবী অভিজিৎ সোম বলেন, এই পচাগলা সমাজে এটি একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। একজন বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক প্রতিদিন এমন একটা ভালো কাজ করছেন, এটা ভাবতেও ভালো লাগে। তিনি এই এলাকার গর্ব।

একজন শান্তি ভুবন দাস

১৯৭৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি পাউবোার কার্যসহকারী হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন শান্তি ভুবন। তাঁর প্রথম কর্মস্থল ছিল ফরিদপুর। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত রাজবাড়ী পাউবোতে কর্মরত ছিলেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি থেকে অবসর নেন। এখন শহরের ভবানীপুরে বিশুদ্ধ পানি বিক্রির একটা প্রতিষ্ঠান (কুশল ড্রিংকিং ওয়াটার) চালান।

শান্তি ভুবনের স্ত্রী নমিতা দাস বলেন, ‘প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগত। একে তো ভোরে উঠে বের হতেন। আবার অনেকে নানা ধরনের কটূক্তি করত। কিন্তু তিনি কারও কথায় কান দেননি। শীত-গ্রীষ্ম নেই, কাজ করে গেছেন। এখন এক দিন ঝাড়ু না দিলে সবাই ভাবেন, তিনি অসুস্থ। বাড়িতে খোঁজ–খবর নিতে আসেন। সবাই এখন খুব প্রশংসা করেন। টুকটাক সহযোগিতাও করেন। যেমন ময়লা পোড়ানোর সময় সঙ্গে দিয়াশলাই না থাকলে এনে দেন। কাজ করার সময় গল্প করেন।’

শান্তি ভুবনের দুই ছেলে। বড় ছেলে কামনাশীষ দাস বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। ছোট ছেলে দেবাশীষ দাস সিএনজি অটোমোবাইল প্রকোশলী হিসেবে চট্টগ্রামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। দুজনই বিবাহিত।

রোজকার রুটিন সম্পর্কে জানতে চাইলে শান্তি ভুবন বলেন, দুপুরে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে ফিরে বাসায় এসে খাওয়াদাওয়া করেন, বিশ্রাম নেন, পত্রিকা পড়েন, টেলিভিশন দেখেন। তবে ঘুমান না। বিকেলে আবার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যান। সন্ধ্যায় বাড়িতে ফেরেন। গল্প করেন। রাতের খাবার খান। রাত ৯টার দিকে ঘুমিয়ে পড়েন।
খানিক থেমে আবার বলেন, ‘আমি সাধারণত অসুস্থ হই না। ভোরের নির্মল বাতাস পাই। এরপর সড়ক ঝাঁট দেওয়ায় ভালো ব্যায়ামও হয়ে যায়।’