অগ্রহায়ণের মাঠে মাঠে সোনালি ধানের ঘ্রাণ আর ধূসর খড়ের মায়া
‘আগন (অগ্রহায়ণ) মাসের’ পথে পথে এখন নানা রকম ধান আর শুকনা খড়-বিচালির ঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে। গ্রামের বাতাসে যেদিকে যাই, সেই একই ঘ্রাণ, একই গন্ধ। যেদিকেই চোখ যায়, অগ্রহায়ণের মাঠে মাঠে সোনালি ফসলের গা এলানো ঘুম ছাড়া কিছু নেই। কোথাও কোথাও মাঠজুড়ে খড়ের ধূসর দিগন্ত।
মৌলভীবাজারে মাঠের পর মাঠজুড়ে এখন আমন ধান কাটা, ধান তোলা আর খড়। মাঠের বুকে চিকচিক করা রোদে মন ভোলানো সেই পুরোনো, লোকায়ত চেনা রূপ, চেনা মায়া। এখানে এখন সবকিছুকে পেছনে ফেলে মাঠ ও চাষির ভালোবাসা মিশে আছে ধানের উৎসবের রঙে। শালিক, ঘুঘুর সঙ্গে এসব ধানের মাঠ জেগে থাকে সকাল থেকে সন্ধ্যা।
৯ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার মশুরিয়া এলাকার গ্রামীণ একটি পথে হেঁটে যাওয়ার সময় এমন দৃশ্য দেখা যায়।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট, একাটুনা, আখাইলকুড়া, কামালপুর, মোস্তফাপুর; রাজনগর উপজেলার মনসুরনগর, রাজনগর, মুন্সীবাজার, টেংরা; কমলগঞ্জ উপজেলার রহিমপুর, মুন্সীবাজার, আদমপুরসহ বেশ কিছু ইউনিয়ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কোনো কোনো মাঠ থেকে সম্পূর্ণ ধান কেটে ফেলা হয়েছে। কোনো মাঠে এখনো বিচ্ছিন্নভাবে কিছু খেতের ধান কাটা হচ্ছে। ফসল তুলে নেওয়ার পর ‘ধানের সোনার কাজ ফুরায়েছে’ মনে হলেও তাতে মাঠের সৌন্দর্য একটুও ম্লান হয়নি।
কৃষক লেচু মিয়া বলেন, ‘এবার ভালা ধান অইছে। ধান ভালা অইছে না, এ কথা কেউ কইত পারত নায় (পারবে না)।’
ধান তোলার পুরোনো পদ্ধতিতে এখন বদলের হাওয়া লেগেছে। বছর কয়েক আগেও এই অগ্রহায়ণে সাধারণ কৃষক কাস্তে দিয়ে ধান কেটে, তা কাঁধ ভারে বাড়িতে নিয়ে এসেছেন। দল বেঁধে ধান কাটা হয়েছে। ধান কাটা শেষের দিকে পিছিয়ে পড়া কৃষককে প্রতিবেশীরা ধান কাটা, ধানমাড়াইয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সবার মধ্যে একধরনের কৃষিনির্ভর যোগসূত্র ছিল, সম্পর্ক ছিল, সামাজিক বাঁধন ছিল।
লোকগবেষক লেখক আহমদ সিরাজ প্রথম আলোকে বলেন, সবকিছু যন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়ছে। আগে অগ্রহায়ণ মাস এলে গরু দিয়ে ধানমাড়াই হয়েছে। অনেক লোক সমবেত হয়ে গান গেয়েছেন, পুঁথিপাঠ করেছেন। সমবেতভাবে কৃষিকাজ করেছেন। নতুন ধানের পিঠা হতো। সবাই মিলে আনন্দ করেছেন, খাওয়াদাওয়া করেছেন। কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ হচ্ছে, আর মানুষের মধ্যে সম্মিলিতভাবে কাজ করা, সবাই মিলে চলার সুযোগ কমে যাচ্ছে। সমাজে বিচ্ছিন্নতাবোধ, আত্মকেন্দ্রিকতা তৈরি হয়েছে। অগ্রহায়ণকেন্দ্রিক অনেক পিঠা, খাবারদাবার গ্রাম থেকেও লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এ বছর ৯৮ হাজার ২০ হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদ হয়েছে। এ পর্যন্ত ৮৫ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। এ বছর প্রতি হেক্টরে সম্ভাব্য ফসল উৎপাদন অনুমান করা হচ্ছে সাড়ে চার টন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. জালাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বছর কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়া গেছে। সময়মতো বৃষ্টিপাত; অর্থাৎ যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু বৃষ্টিপাত হয়েছে। আবহাওয়া কৃষির অনুকূল ছিল। কোনো রকম দুর্যোগ না হওয়ায় ভালো ফসল হয়েছে।’