ইতালি যাওয়ার পথে নিখোঁজ, চোখের জলে দিন কাটে পরিবারের

লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয়েছেন শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার বিন্দাইকাঠি গ্রামের ফয়সাল মাদবর। চার মাস ধরে তাঁর সন্ধান না পেয়ে মা মঞ্জিলা বেগম দিন-রাত কেঁদে যাচ্ছেন
ছবি: প্রথম আলো

আলী আকবরের বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন তাঁর বাবা মারা যান। মা মাসুদা বেগম শ্রমিকের কাজ করে ছেলেকে পড়ালেখা শেখান। পরিবারের দারিদ্র্য দূর করতে গত বছরের অক্টোবরে লিবিয়া যান আকবর। সেখান থেকে সমুদ্রপথে রওনা দেন ইতালির উদ্দেশে। এরপর চার মাস ধরে পরিবার তাঁর কোনো সন্ধান পাচ্ছে না। তিনি বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন, এ খবরও কেউ জানেন না। ছেলের খোঁজ পাবেন, এমন আশায় মা মাসুদা বেগম চোখের পানি ফেলে যাচ্ছেন।

আলী আকবরের (২৩) বাড়ি শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার মডেরকান্দি গ্রামে। শুধু আলী আকবরই নন, চার মাস ধরে নিখোঁজ আছেন ডামুড্যার বিন্দাইকাঠি গ্রামের রফিক ব্যাপারীর ছেলে কামাল ব্যাপারী (৩৯), বাবু মাদবরের ছেলে ফয়সাল মাদবর (২৫) ও সদর উপজেলার দরিহাওলা গ্রামের রূপচান ফকিরের ছেলে শওকত ফকির (২৭)।

দালালের মাধ্যমে তাঁরা প্রথমে লিবিয়া যান। এরপর আবার দালালের সহায়তায় ট্রলারে (ইঞ্জিনচালিত নৌকা) করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালির উদ্দেশে রওনা দেন। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ট্রলারডুবিতে তাঁরা নিখোঁজ হয়েছেন বলে পরিবারের ধারণা।

আলী আকবরের মা মাসুদা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, দারিদ্র্যের কারণে তাঁর ছেলে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর স্থানীয় একটি ওয়ার্কশপে কাজ নেন। এরপর হঠাৎ ইতালি যাওয়ার বায়না ধরেন। এনজিও থেকে ঋণ ও ধারদেনা করে তাঁকে ইতালি পাঠানোর ব্যবস্থা করেন মা। তাঁদের পাশের গংগেসকাঠি গ্রামের বাচ্চু ব্যাপারীর সঙ্গে ১১ লাখ টাকায় চুক্তি হয়। দুই দফায় বাচ্চুর বাবা মজিবর ব্যাপারীর কাছে টাকা দেন। লিবিয়া নিয়ে প্রথমে চার মাস আটকে রাখেন। এরপর আবার টাকা পাঠানোর পর ‘গেম দিতে’ (ট্রলারে করে সাগর পাড়ি দিতে) রাজি হন। ছেলে ১২ এপ্রিল রাতে ফোন দিয়ে জানান, পরদিন তাঁদের নিয়ে ট্রলার ইতালির উদ্দেশে রওনা দেবে। এরপর আর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘বাচ্চুর লোকজন এলাকায় প্রচার দিয়েছে, ট্রলারডুবিতে তাদের মৃত্যু হয়েছে। আমরা জানি না ছেলের ভাগ্যে কী ঘটেছে। আমরা এখন দিশেহারা। একদিকে ঋণের চাপ, অন্যদিকে ছেলের শোকে কাতর হয়ে পড়েছি।’ এ ঘটনায় তাঁর আরেক ছেলে শরীয়তপুর আদালতে বাচ্চু ব্যাপারী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন বলে জানান তিনি।

পুলিশ, প্রবাসীদের পরিবার ও ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে শরীয়তপুরের বিভিন্ন গ্রামের যুবক ও তরুণদের অবৈধভাবে লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি পাঠাচ্ছে একটি দালাল চক্র। ওই চক্রের ফাঁদে পা দিয়ে অনেকে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। অনেকে ট্রলারডুবিতে প্রাণ হারাচ্ছেন। অনেককে জিম্মি করে পরিবার থেকে মুক্তিপণের টাকা আদায় করা হচ্ছে।

গংগেসকাঠি গ্রামের মজিবর ব্যাপারীর ছেলে বাচ্চু ব্যাপারী একটি দালাল চক্রের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। বাচ্চুর মাধ্যমে গত বছরের অক্টোবর থেকে এ বছর জানুয়ারির মধ্যে ইতালির উদ্দেশে বাড়ি ছাড়েন ডামুড্যার বিন্দাইকাঠি গ্রামের কামাল ব্যাপারী, ফয়সাল মাদবর, মডেরকান্দি গ্রামের আলী আকবর ও সদর উপজেলার দরিহাওলা গ্রামের শওকত ফকির। তাঁদের প্রত্যেকের কাছ থেকে বাচ্চু ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা ১১ লাখ করে টাকা নেন। সংযুক্ত আরব আমিরাত হয়ে তাঁদের নেওয়া হয় লিবিয়ার উপকূলীয় একটি এলাকায়। সেখানে কিছুদিন দালালদের ক্যাম্পে রাখা হয়। এরপর তাঁদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে চুক্তির বাকি টাকা নেওয়া হয়। তারপর তাঁদের ট্রলারে করে ইতালি পাঠানোর জন্য ভূমধ্যসাগরে ছেড়ে দেওয়া হয়।

ওই দালালদের ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসেন বিন্দাইকাঠি গ্রামের রহমান কবিরাজের ছেলে নাজমুল কবিরাজ (২৩)। তিনি এখন লিবিয়ার একটি শহরে নির্মাণশ্রমিকের কাজ করছেন। নাজমুলের মা লুৎফা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দালালেরা আমার ছেলেকে অপহরণকারীদের হাতে তুলে দিয়েছিল। ৩ জুলাই সেখান থেকে সে পালিয়ে আসে। ফোনে আমাদের জানিয়েছে, সে নিরাপদে আছে। একটি শহরে নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করছে।’

বিন্দাইকাঠি গ্রামের কামাল ব্যাপারী গ্রামে টাইলসমিস্ত্রির কাজ করতেন। যা আয় হতো তা দিয়ে চার সন্তান, স্ত্রী ও মা–বাবাকে নিয়ে সংসার চলছিল না। তখন ইতালি যাওয়ার জন্য বাচ্চু ব্যাপারীর সঙ্গে চুক্তি করেন। দুই দফায় বাচ্চুর পরিবারকে ১১ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে কামালের পরিবার। গত ১৭ এপ্রিল কামাল স্ত্রীকে ফোন করে জানান, পরের দিন তাঁদের নিয়ে ট্রলার ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাবে। এর পর থেকে আর তাঁর আর কোনো সন্ধান পাচ্ছে না পরিবার।

কামালের স্ত্রী মনি আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, পরিবারের দারিদ্র্য দূর করতে ও সন্তানদের উন্নত জীবন দিতে তাঁর স্বামী ইতালি যেতে চেয়েছিলেন। বিভিন্ন স্থান থেকে ঋণ করে তাঁকে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বাড়ি ছাড়েন তিনি। তিন মাস তাঁকে বিভিন্ন ক্যাম্পে রাখা হয়। ১৭ এপ্রিল রাতে ফোন করে কামাল জানান, পরদিন ইতালির উদ্দেশে রওনা দেবেন। এরপর আর খোঁজ পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, ‘বাচ্চু দালালের লোকজন আমাদের জানিয়েছে, ট্রলারডুবিতে আমার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে। আমি চার শিশুসন্তান নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছি। দুজনকে ওয়ার্কশপে কাজে লাগিয়ে দিয়েছি। এমন পরিস্থিতি দেখে শ্বশুর স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে পড়েছেন।’

শওকত ফকিরের মা সুফিয়া বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ১২ এপ্রিল ছেলের সঙ্গে শেষ কথা হয় তাঁর। পরদিন তাঁদের বহন করা ট্রলার সাগর পাড়ি দেবে, এমন কথা বলে দোয়া চেয়েছিলেন ছেলে। তিনি এখন কোথায় আছেন, কেমন আছেন, বেঁচে আছে না মারা গেছেন, কিছুই জানেন না এই মা। অন্যদিকে দালালের ফোনও বন্ধ।

ফয়সাল মাদবরের মা মঞ্জিলা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আল্লাহই জানেন, আমার ছেলের কপালে কী ঘটেছে। যে দালালের মধ্যমে ছেলেকে পাঠিয়েছি, সেই বাচ্চু এখন লিবিয়ায়। সেও আমাদের ফোন ধরে না। ছেলে ফিরে আসবে, এমন আশা নিয়ে বসে আছি।’

বাচ্চু ব্যাপারীর বাড়িতে গিয়ে তাঁর বাবা মজিবর ব্যাপারীকে পাওয়া যায়নি। তাঁর মা জয়গুন বিবি প্রথম আলোকে বলেন, বাচ্চু লিবিয়ায় আছে। আর তাঁর বাবা এলাকার মানুষের চাপে আত্মগোপনে চলে গেছেন।

জানতে চাইলে শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, শরীয়তপুর থেকে অবৈধ পথে ইউরোপে মানুষ পাঠানোর কয়েকটি ঘটনা পুলিশের নজরে এসেছে। যে চক্র এ কাজের সঙ্গে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার জন্য পুলিশ কাজ করছে। ডামুড্যা ও সদরের কয়েকজন নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে একটি মামলা হয়েছে। সেটির তদন্ত করা হচ্ছে।