রাজশাহী ভ্রমণে পাবেন পুরোনোর সঙ্গে নতুনের মিশেল
রাজশাহী মানেই ঐতিহ্যের মোড়কে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অপরূপ হাতছানি। পুঠিয়া রাজবাড়ির স্থাপত্যশৈলী যেমন নজর কাড়ে, ‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতার কবি রজনীকান্ত সেনের বাড়ি তাদের স্মৃতিকাতর করে। শহর থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরের তানোর উপজেলায় ছড়িয়ে রয়েছে মোগল আমলের বেশ কিছু স্থাপত্যনিদর্শন। বিলকুমারীর বিল মুগ্ধতা ছড়ায়। পুরোনোর সঙ্গে নতুনের মিশেল পাওয়া যাবে সাজানো–গোছানো সুন্দর শহর রাজশাহীতে। ফেরার সময় সঙ্গে ক্যামেরা থাকলে নেমে পড়তে পারেন পদ্মা নদীতে। এই শীতে দেখা মিলতে পারে চখাচখিসহ অনেক পরিযায়ী পাখির।
পুঠিয়া রাজবাড়ী
রাজশাহী থেকে সড়কপথে ২৮ কিলোমিটার দূরে পুঠিয়া রাজবাড়ি। রাজশাহী-নাটোর মহাসড়ক থেকে হেঁটে অথবা পাঁচ টাকা রিকশাভাড়া দিয়ে রাজবাড়িতে যাওয়া যায়। রাজবাড়ির চারদিকে নিরাপত্তার জন্য পরিখা খনন করা ছিল। এখনো তার অংশবিশেষ দেখা যাবে। ঢুকতেই হাতের বাঁ পাশে চোখে পড়বে শিবমন্দির। রানি ভুবনময়ী দেবী ১৮২৩ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু করেছিলেন। ১৮৩০ সালের এর নির্মাণ শেষ হয়। চার মিটার উঁচু চূড়ার পরে মন্দির। মন্দিরের ওপর চার কোনায় চারটি ও কেন্দ্রস্থলে চারটি চূড়া আছে। কেন্দ্রীয় চূড়াটি প্রায় ২০ মিটার উঁচু। উত্তর পাশে পরিখার পানিতে তাকালে একসঙ্গে দেখা যাবে। বড় শিবমন্দির ও তার পূর্ব পাশের রথমন্দির বা জগন্নাথ। পানিতে এই স্থাপনার প্রতিবিম্ব দেখেই মুগ্ধ হতে হয়।
এর দক্ষিণ পাশেই চোখে পড়বে দোলমন্দির। মাটি থেকে ২০ মিটার উঁচু এই মন্দিরের প্রতি তলের চারদিকে প্রশস্ত টানা বারান্দা, নিচতলায় প্রতি বাহুতে সাতটি, দ্বিতীয় তলায় পাঁচটি, তৃতীয় তলায় তিনটি ও চতুর্থ তলায় একটি করে প্রবেশদ্বার আছে। এই মন্দিরের সামনেই রাজবাড়ি। বাড়ির সামনে প্রশস্ত আঙিনা। সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা।
রাজবাড়ির মোট ভূমির আয়তন ৪ দশমিক ৩১ একর। ১৮৯৫ সালে মহারানি হেমন্তকুমারী এটি নির্মাণ করেন। রাজবাড়ির উত্তর পাশে দোলমন্দির, পশ্চিম পাশে শ্যাম সরোবর, পেছনে; অর্থাৎ দক্ষিণ পাশে রানিমহল, পূর্ব পাশে বড় গোবিন্দমন্দির ও রানিঘাট।
শ্যাম সরোবরের পশ্চিম পাশে বড় আহ্নিক মন্দির, ছোট গোবিন্দমন্দির ও গোপালমন্দির। এর দক্ষিণ পাশেই রয়েছে ধ্বংস প্রায় চারিআনা রাজবাড়ি। এর সামনে থেকে উত্তর–পূর্ব দিকে তাকিয়ে চোখ জুড়িয়ে যাবে। একসঙ্গে চোখে পড়বে শিবমিন্দর, দোলমন্দির ও রাজবাড়ির অংশবিশেষ। এটি রাজাবাড়ির সবচেয়ে মনোরম দৃশ্য। মূল রাজবাড়িটি এখন জাদুঘর। এখানে রাজবাড়ির সিন্দুকসহ অনেক নির্দশন সংরক্ষিত রয়েছে। এই রাজবাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার পশ্চিমে তারাপুর গ্রামে রয়েছে হাওয়াখানা ভবন। দিঘির মাঝখানে এই দ্বিতল ভবন।
বাঘা শাহি মসজিদ ও দিঘি
রাজশাহী শহর থেকে ৪৪ কিলোমিটার পূর্ব দিকে বাঘা শাহি মসজিদ অবস্থিত। বাঘা-লালপুর সড়ক থেকে উত্তর দিকে তাকালে সোজা চোখ চলে যায় চৌচালা গম্বুজের দিকে। মসজিদে চমৎকার কারুকাজ আর টেরাকোটার নকশা। বাংলাদেশের ৫০ টাকার পুরোনো নোট আর ১০ টাকার স্মারক ডাকটিকিটে দেখা মেলে প্রাচীন স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন এই মসজিদের। এটি রাজশাহীর ‘বাঘা শাহি মসজিদ’।
মসজিদটির নামফলকে এর নির্মাণকাল লেখা রয়েছে ‘১৫২৩-২৪ খ্রিষ্টাব্দ’। সেই হিসাবে ২০২৪ সালে মসজিদের বয়স ৫০০ বছর পূর্ণ হয়েছে। বাংলার স্বাধীন সুলতান নুসরত শাহ এটি নির্মাণ করেছিলেন। সামনে খনন করেছিলেন বিশাল এক দিঘি। মসজিদটির স্থাপত্যশৈলীর আকর্ষণে দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকেরা প্রতিনিয়ত আসেন বাঘায়।
দশ গম্বুজের এই মসজিদে রয়েছে পাঁচটি দরজা। মাঝখানের দরজার ওপর ফারসি হরফে লেখা একটি শিলালিপি রয়েছে। চার কোনায় রয়েছে চারটি চৌচালা গম্বুজ, ভেতরে ছয়টি স্তম্ভ, চারটি অপূর্ব কারুকার্যখচিত মেহরাব। এর নকশায় রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী আম, গোলাপ ফুলসহ নানা রকম নকশা। মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৭৫ ফুট, প্রস্থ ৪২ ফুট, উচ্চতা সাড়ে ২৪ ফুট। দেয়াল চওড়া ৮ ফুট। গম্বুজের ব্যাস ২৪ ফুট, উচ্চতা ১২ ফুট। সবখানেই টেরাকোটার নকশা। কিছু কিছু জায়গায় লোনা ধরে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ২০০৭ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ অনুরূপ নকশা প্রতিস্থাপন করেছে। সিরাজগঞ্জের টেরাকোটাশিল্পী মদন পাল কাজটি করেছিলেন। যাঁরা আগের নকশা দেখেননি, মদন পালের নকশার সঙ্গে আগের নকশার পার্থক্য তাঁরা বুঝতে পারবেন না।
এই মসজিদ ঘিরে প্রায় ২৫৬ বিঘা জমির ওপর সুবিশাল দিঘি, আউলিয়াদের মাজার, মূল দরগাহ শরিফ, মহিলা মসজিদ, গোপন সুড়ঙ্গপথ ও জাদুঘর। সবই দর্শনীয়। আগে শীতে অসংখ্য পরিযায়ী পাখি আসত এই দিঘিতে। এখন এই দিঘির চারপাশ দিয়ে ঘুরে দেখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর
নগরের হেতেমখাঁ এলাকায় ১৯১০ সালে বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির সংগ্রহ নিয়ে জাদুঘরের যাত্রা শুরু হয়। গৌড়ের স্থাপত্যশৈলীর অনুকরণে একটি ভবন নির্মাণ করান নাটোরের দীঘাপাতিয়ার রাজকুমার শরৎকুমার রায়। জানা যায়, এর নকশা তিনি নিজেই করেছিলেন। জাদুঘরটি ১৯৬৪ সাল থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে এই জাদুঘরের সংগ্রহে আছে ১৭ হাজারের বেশি দুর্লভ সংগ্রহ।
জাদুঘরে ঢুকলেই দর্শনার্থীরা প্রথম প্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে পরিচিত হবেন। প্রথমেই অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র ছবি। তিনি ছিলেন বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির পরিচালক। মাঝখানে শরৎকুমার রায়ের ছবি। তিনি ছিলেন সমিতির সভাপতি। তারপর আছে জাদুঘরের প্রথম অনারারি কিউরেটর রমাপ্রসাদ চন্দের ছবি।
এরপর গ্যালারিতে ঢুকতেই দেখা মিলবে টেরাকোটার বিষ্ণুমূর্তি। পোড়ামাটিতে তৈরি হলেও এখনো অটুট আছে বিষ্ণুমূর্তিটির নিটোল চোখমুখ। এটিই এখন দেশে টেরাকোটায় তৈরি একমাত্র বিষ্ণুমূর্তি। এরপরের গ্যালারিতেই দেখা যাবে লক্ষ্মণ সেনের বাগবাড়ী শিলালিপি। ‘কুটিল’ হরফে লেখা এই শিলালিপিতে লক্ষ্মণ সেনের রাজবংশের পরিচয় লেখা আছে। আছে নানা সংগ্রহ।
জাদুঘরে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ত্রয়োদশ শতকের কোনো এক সময়ে তালপাতায় লিখিত ও রঙিন চিত্রকর্ম দ্বারা শোভিত দুটি পুঁথি। নাম ‘অষ্টসহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা’। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছে অতি অনুসরণীয় ও সম্মানিত গ্রন্থ ‘অষ্টসহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা’। আট হাজার লাইনে লেখা একটি পুঁথিতে ছয়টি ও অপরটির ৪৯টি পাতায় দেব–দেবীর ৪৯টি রঙিন ছবি স্থান পেয়েছে। ছবিগুলোর রং-রেখা হাজার বছর পরও অটুট রয়েছে। বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের ‘অষ্টসহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা’ পুঁথির চিত্র বাংলার প্রাচীন চিত্রশিল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এ ধরনের পাণ্ডুলিপি বা পাণ্ডুলিপির খণ্ডাংশ বাংলাদেশের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে নেই।
জাদুঘরের নতুন ভবনের নিচতলায় আবহমান বাংলা ও মুসলিম ঐতিহ্যের নিদর্শন স্থান পেয়েছে। জাদুঘরের সাপ্তাহিক বন্ধের দিন বৃহস্পতি ও শুক্রবার। জাদুঘর দেখার জন্য সম্প্রতি ১০ টাকা দর্শনী নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের দর্শনীমূল্য লাগবে না। এ ছাড়া স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা এলে পরিচালক অর্ধেক দর্শনীর বিনিময়ে প্রদর্শনী দেখার সুযোগ করে দিতে পারেন।
রজনীকান্ত সেনের বাড়ি
আজ থেকে আট বছর আগে কলকাতার সংগীত পরিচালক দিলীপ কুমার রায় রাজশাহীতে এসেছিলেন। তিনি ছুটে গিয়েছিলেন কবি রজনীকান্ত সেনের ‘আনন্দ নিকেতন’ নামের বাড়িতে। রজনীকান্ত ছিলেন তাঁর নানা। নগরের সাহেববাজার এলাকার ওই বাড়ি থেকে ফেরার সময় দিলীপ ওই ভিটা থেকে ইটের দুটি টুকরা কুড়িয়ে নিয়ে যান।
রজনীকান্ত সেনের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়েছিল রাজশাহীর বোয়ালিয়া জিলা স্কুলে (বর্তমান রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল)। কলকাতা সিটি কলেজ থেকে ১৮৯১ সালে তিনি বিএল পাস করে রাজশাহীতে ওকালতি শুরু করেন। কবির মৃত্যুর পর ফাঁকা পড়ে থাকে আনন্দ নিকেতন নামের ওই বাড়ি। দেশভাগের পর তাঁর বাড়িটি রাষ্ট্রের অধীনে চলে যায়। স্বাধীনতার পর ১৯৮০ সালে জেলা প্রশাসন বাড়িটি সোনালী ব্যাংককে বরাদ্দ দেয়। এখন বাড়িটি সোনালী ব্যাংকের রাজশাহী করপোরেট শাখার পাসপোর্ট বুথ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাড়ির পেছনে উঁচু ভিটা। শহরের ময়লা-আবর্জনা ফেলায় ঢিবির মতো উঁচু হয়েছে। এসব ছাপিয়ে ঝোপঝাড় উঠেছে। আনন্দ নিকেতন নামটি আর কোথাও লেখা নেই। তবু বাইরে থেকে অনেকেই এই বাড়ি দেখতে এসে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। ১৯২৮ সালে রাজশাহী এসে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রজনীকান্তের আনন্দ নিকেতন পরিদর্শন করেন।
ঋত্বিক ঘটকের বাড়ির ধ্বংসস্তূপ
শহরের মিয়াপাড়া এলাকায় ছিল কালজয়ী চলচ্চিত্রকার ও পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি। গত ৫ আগস্ট বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এখনো কেউ এলে দেখতে পাবেন বাড়ির ইটগুলো স্তূপ করে রাখা হয়েছে।
রাজশাহী থেকে গিয়ে তানোরের বেশ কয়েকটি প্রাচীন নির্দশন দেখে এক দিনে ফেরা যায়। এর মধ্যে আছে বিহারৈল বৌদ্ধবিহার, মুসলিম স্থাপত্য, ভাগনা মসজিদ, মুণ্ডুমালার তিন গুম্বুজ মসজিদ, মুহাম্মদপুরের তিন গুম্বুজ মসজিদ, রায়তানবড়শোর তিন গুম্বুজ মসজিদ, গোকুল গ্রামের এক গুম্বুজ মসজিদ, ইলামদহ গ্রামের এক গুম্বুজ মসজিদ, আড়াদিঘির দরগা, পাড়িশো গ্রামের মহরমের দরগা, কৃষ্ণপুরের মানিক পীরের দরগা, তালন্দ জমিদার বাড়ির শিবমন্দির।
পদ্মা নদীতে পাখি দেখা
রাজশাহী শহরের দক্ষিণ পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মা নদী। এখন পদ্মা নদীতে পরিযায়ী পাখির দেখা পাওয়া যায়। পাখিদের বিরক্ত না করে নৌকা নিয়ে দুরবিনে চোখ রেখে পাখি দেখা যায়। নগরের পুলিশ লাইনসের পাশে মাঝিরা ছোট ছোট নৌকা নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন।