র‍্যাব পরিচয় দেওয়া অপহরণকারীদের যেভাবে ধাওয়া দিয়ে ধরল জনতা

টাঙ্গাইল জেলার মানচিত্র

টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলায় র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) সদস্য পরিচয়ে ব্যবসায়ীকে তুলে নিয়ে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনায় মির্জাপুর থানায় মামলা হয়েছে। গতকাল শনিবার রাতে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পাওয়া ব্যবসায়ী মান্নান মিয়া বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলায় জনতার হাতে আটক অপহরণে অভিযুক্ত সাইম ও মাইক্রোবাসচালক বেল্লাল হোসেনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

অপহরণের শিকার মান্নান মিয়া উপজেলার মহেড়া ইউনিয়নের গবড়া গ্রামের বাসিন্দা। তিনি মহেড়া বাজারে (রেলগেট–সংলগ্ন) মুঠোফোনে আর্থিক লেনদেনের ব্যবসা করেন। পাশাপাশি আলু, শর্ষেসহ মৌসুমী ব্যবসা করেন। তাঁর তিন ভাই প্রবাসী।

পুলিশের কাছে অভিযোগে মান্নান মিয়া বলেছেন, শুক্রবার রাত সাড়ে আটটার দিকে র‍্যাবের পোশাক পরা সশস্ত্র পাঁচজন লোক তাঁর দোকানে প্রবেশ করেন। এ সময় দোকানে তিনিসহ আরও কয়েকজন ছিলেন। র‍্যাব পরিচয়ধারীরা মান্নানের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা ও অনলাইনে জুয়া খেলার অভিযোগ তুলে তাঁর হাতে হাতকড়া পরান। দোকানের ক্যাশ বাক্স ভেঙে সেখানে থাকা নগদ পাঁচ হাজার টাকা, মুঠোফোন, ল্যাপটপ ও ডেস্কটপ কম্পিউটার নিয়ে নেন। এরপর তাঁকে মুখে ও চোখে গামছা বেঁধে কালো রঙের একটি মাইক্রোবাসে তোলা হয়। অপহরণকারীরা মান্নানের কাছে ২ কোটি টাকা দাবি করেন। না হলে মেরে ফেলার হুমকি দেন। তখন তিনি তাঁর সঙ্গে থাকা মুঠোফোনের বিভিন্ন ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় তিন লাখ টাকা দেন।

এই টাকায় রাজি হননি অপহরণকারীরা। তাঁরা মান্নানের গলায় গামছা দিয়ে শ্বাসরোধ করে, কানে সাঁড়াশি দিয়ে চাপ দেওয়াসহ শারীরিক নির্যাতন শুরু করেন। একপর্যায়ে দর-কষাকষির পর অপহৃত মান্নান তাঁর ভাই হান্নান মিয়ার কাছে মুঠোফোনে ১২ লাখ টাকা নিয়ে অপহরণকারীদের নির্দেশিত স্থানে আসতে বলেন। কথামতো মান্নান মিয়া জমি বন্ধক, ধার ও সুদে ১২ লাখ টাকা জোগাড় করে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের নাটিয়াপাড়া এলাকায় গিয়ে অপহরণকারীদের হাতে টাকা তুলে দেন। রাত ১২টার দিকে তাঁরা টাকা পেয়ে মান্নানকে সেখানেই মাইক্রোবাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন।

যেভাবে ধরা খেলেন দুই অপহরণকারী

অপহরণের ঘটনার পর হান্নান মিয়া তাঁদের বাড়ির নির্মাণকাজের জন্য রাখা শ্রমিকের মজুরি, কিছু জমি গ্রামের মানুষের কাছে বন্ধক, প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ধার ও সুদ নিয়ে ১২ লাখ টাকা জোগাড় করেন। অপহরণকারীদের কাছে টাকা পৌঁছানোর সময় শর্ত ছিল, তিনি পুলিশে জানাতে পারবেন না বা কাউকে সঙ্গে নিতে পারবেন না। এর ব্যত্যয় হলে তাঁর ভাইকে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দেন অপহরণকারীরা। এরপর তিনি নিজে একটি, তাঁর ভাতিজা ও প্রতিবেশীদের আরও দুইটি মোটরসাইকেল নিয়ে টাকাসহ রওনা হন। তাঁদের তিনটি মোটরসাইকেলে মধ্যে একটি ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের জামুর্কী এলাকায় ও অপরটি নাটিয়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডের পশ্চিম পাশে অবস্থান নেয়। অপর মোটরসাইকেলে হান্নান মিয়া একাই টাকা নিয়ে রওনা হন।

হান্নান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, অপহরণকারীদের হাতে টাকা তুলে দেওয়ার পর তাঁদের ব্যবহৃত মাইক্রোবাসটি প্রথমে ঢাকার দিকে রওনা হয়। এটির নম্বর ও রং তাঁরা দেখে রেখেছিলেন। দ্রুত ডুবাইল এলাকা থেকে মাইক্রোবাসটি ঘুরে টাঙ্গাইলের দিকে রওনা হয়। মোটরসাইকেল নিয়েই তাঁরা মাইক্রোবাসের পিছু নেন। তাঁরা প্রথমে টাঙ্গাইলের করটিয়াতে মাইক্রোবাসের সামনে একটি মোটরসাইকেল আড়াআড়ি করে গতিরোধের চেষ্টা করেন। কিন্তু চালক তা থামাননি। এ সময় হান্নানের হাতে থাকা একটি টর্চলাইট দিয়ে মাইক্রোবাসের জানালার কাচ ভাঙেন। এরপর মাইক্রোবাস সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। তাঁরাও পিছু নেন। মাইক্রোবাসটি টাঙ্গাইলের রাবনা বাইপাসের উড়াল সড়কে গিয়ে জটে পড়ে। তখন তাঁরা মোটরসাইকেল নিয়ে সামনে গিয়ে গতি রোধের চেষ্টা করেন। এ সময় অপর একটি বাসের চালককে তাঁরা চিৎকার করে মাইক্রোবাসের গতিরোধের অনুরোধ করলে তিনি বাসটি আড়াআড়ি রাখেন। পরে হান্নান, তাঁর ভাই অপহৃত মান্নান, ভাতিজা আতিকসহ সঙ্গে থাকা আরও তিনজন অপহরণকারীদের সঙ্গে মারামারিতে লিপ্ত হন। একপর্যায়ে লোকজন আসতে দেখে অন্য অপহরণকারীরা টাকা নিয়ে পালিয়ে যান। জনতার হাতে আটকা পড়েন দুজন। তাঁদের গণধোলাই শেষে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।

মারামারির সময় অপহরণকারীদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মান্নানের ভাতিজা আতিক মিয়া আহত হয়েছেন। মান্নান, আতিকসহ ওই দুজনকেও চিকিৎসার জন্য টাঙ্গাইলের শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। চিকিৎসার পর গতকাল শনিবার মান্নান ও আতিক হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরেন।

মির্জাপুর থানার উপপরিদর্শক আবুল বাশার মোল্লা বলেন, মুক্তিপণ বাবদ দেওয়া টাকা উদ্ধার ও অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। মাইক্রোবাসটি জব্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া অপহরণকারীদের ব্যবহৃত র‍্যাবের পোশাক, ধারালো অস্ত্র ও খেলনা পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে।