কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদের দানসিন্দুকে এবার ২৩ বস্তা টাকা জমেছিল। গত শনিবার সকাল আটটায় এসব টাকা গণনা শুরু হয়। শেষ হয় রাত সাড়ে নয়টায়। পাওয়া যায় ৫ কোটি ৭৮ লাখ ৯ হাজার ৩২৫ টাকা, যা এযাবৎকালের দানের টাকা পাওয়ার সর্বোচ্চ রেকর্ড।
প্রায় তিন মাস পরপর পাগলা মসজিদের এসব দানসিন্দুক খোলা হয়। বিপুল পরিমাণ এই টাকা গণনা এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। দিনব্যাপী টাকা গণনায় অংশ নেন মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী, ব্যাংক কর্মকর্তা, মসজিদের কর্মচারীসহ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যক্তিরা। শনিবার টাকা গণনায় মোট ২৭৮ জন যুক্ত ছিলেন।
মসজিদ কমিটি সূত্রে জানা যায়, নূরুল কোরআন হাফিজিয়া মাদ্রাসার ১৩৮ জন খুদে শিক্ষার্থী, রূপালী ব্যাংকের ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিভিন্ন শাখা থেকে আসা ৭০ জন ব্যাংক কর্মকর্তা, পাগলা মসজিদের ৩৬ জন স্টাফ, সশস্ত্র আনসার ১০ জন, ৯ জন পুলিশ সদস্য, ২ জন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, ট্রেজারার, সদর ইউএনওসহ ৬ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, সিন্দুক খোলার উপকমিটির ২ জন সদস্যসহ পদাধিকারবলে মসজিদ কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার টাকা গণনার কাজে সম্পৃক্ত থাকেন।
সরেজমিন দেখা যায়, শনিবার সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, মসজিদের স্টাফ, ব্যাংকের কর্মকর্তাসহ সবাই টাকা গণনার জন্য হাজির হন। সকাল পৌনে আটটার দিকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও দানসিন্দুক খোলা কমিটির আহ্বায়ক কাজী মহুয়া মমতাজ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এ টি এম ফরহাদ চৌধুরী ও ট্রেজারার দানের টাকা জমা হওয়া ৮টি লোহার সিন্দুকের ৩২টি তালার চাবি নিয়ে উপস্থিত হন। এর ১৫ মিনিট পর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ আসেন। এরপর প্রথমে মসজিদের মূল ভবনের দক্ষিণ পাশে বাইরে রাখা লোহার সিন্দুকটি খোলা হয়। টাকা দিয়ে ঠাসাঠাসি করে ভরা সিন্দুকটির মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রা, স্বর্ণালংকারও পাওয়া যায়। পরে সিন্ধুক থেকে টাকা নিয়ে প্লাস্টিকের বস্তায় তোলা হয়। একটি সিন্দুকের টাকা সংগ্রহে অন্তত তিনটি প্লাস্টিকের বস্তা লাগে।
এভাবে একে একে ৮টি সিন্দুকের টাকাসহ অন্যান্য জিনিস ২৩টি বস্তায় ভরা হয়। ম্যাজিস্ট্রেট ও নিরাপত্তাকর্মীদের উপস্থিতিতে পরে বস্তাগুলো মাথায় করে মসজিদের স্টাফরা ওপরে মসজিদের দোতলায় নিয়ে যান। সেখানে চার সারিতে বসে থাকা শিক্ষার্থীদের মাঝে টাকার বস্তা ঢালা হয়। শিক্ষার্থীরা টাকার নোটগুলো গোছানোর কাজ করে। এর মধ্যে কাউকে ১০০০ হাজার টাকার নোট, কাউকে আবার ৫০০ টাকার নোট, কাউকে ২০০ কিংবা ১০০ টাকার নোট গোছানোর দায়িত্ব আগে থেকেই দেওয়া থাকে। কেউ আবার টাকার বস্তা ঢালার পর বের হওয়া বৈদেশিক মুদ্রা, স্বর্ণালংকারসহ হীরার জিনিসপত্র আলাদা করে রাখে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা গোছানো টাকার নোটগুলো একত্রে সংগ্রহ করেন। তাঁরা হাতে টাকা গোনার পর গণনার মেশিন নিয়ে বসা চার কর্মকর্তাকে দেন। মেশিনের মাধ্যমে চূড়ান্ত গণনা শেষে বান্ডিল আকারে বড়–ছোট নোটগুলো আলাদাভাবে সাজিয়ে রাখা হয়। সব টাকা গণনা শেষ হওয়ার পর স্টিলের ট্রাংকে ভরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা ব্যাংকের ভল্টে নিয়ে জমা রাখেন। আর বৈদেশিক মুদ্রাসহ স্বর্ণালংকার নিয়ে জেলা প্রশাসনের ট্রেজারিতে জমা রাখা হয়।
এভাবেই চলে দিনব্যাপী টাকা গণনার পুরো কর্মযজ্ঞ। এর মাঝে শুধু দুপুরে আধা ঘণ্টা সময় জোহরের নামাজ ও খাবারের জন্য বিরতি দেওয়া হয়। টাকা গোনার সময় জরুরি প্রয়োজনে কেউ বাইরে যেতে চাইলে তাকে তল্লাশি করা হয়। যেখানে টাকা গণনা করা হয়, সেখানকার চারদিকে সিসি ক্যামেরার সাহায্যে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করা হয়।
মসজিদ কর্তৃপক্ষ জানায়, টাকাপয়সা, স্বর্ণালংকার ছাড়াও এ মসজিদে নানা নিয়তে দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ কোরআন শরিফ, মোমবাতি, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, ফলফলাদিসহ নানা জিনিসপত্র দান করেন। গত শুক্রবার গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, কবুতর, দুধ, নারকেল দান করেন মানুষ। আসরের নামাজের পর নিলামে এসব মালামাল ২ লাখ ৬৬ হাজার টাকা বিক্রি হয়। শনিবার একটি বাছুর, ছাগল, মোরগ, নারকেল, চাল নিলামে ৫৭ হাজার ৩৭০ টাকায় বিক্রি করা হয়। এভাবে গত তিন দিনের নিলামে ৩ লাখ ৯১ হাজার ৯৩৫ টাকার জিনিস বিক্রি হয়। প্রতিদিন নিলামের টাকা রূপালী ব্যাংকে জমা রাখা হয়।
পাগলা মসজিদ কমিটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. শওকত উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, যেদিন টাকা গণনা করা হবে, এর এক সপ্তাহ আগে থেকেই তাঁদের প্রস্তুতি চলতে থাকে। মসজিদ কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসকের নির্দেশে সিন্দুক খোলার উপকমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) কমিটির সব সদস্যসহ রূপালী ব্যাংকে চিঠি দেন। সিন্দুক খুলে টাকা গণনার দিন নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। টাকা গণনা শেষে আবার ৮টি সিন্দুকের প্রতিটিতে ৪টি করে ৩২টি তালা লাগিয়ে তালাগুলোকে সিলগালা করে চাবিগুলো পুনরায় জেলা প্রশাসনের ট্রেজারিতে জমা রাখা হয়।
জেলা প্রশাসক ও মসজিদ কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, এবার ৮টি সিন্দুক খোলার পর দেখা গেছে, প্রতিটি সিন্দুকভর্তি টাকা। সে জন্য দানের পরিমাণের চাহিদা অনুযায়ী আরও একটি লোহার সিন্দুক বাড়ানোর ব্যবস্থা করা হবে। সপ্তাহখানেকের মধ্যে মসজিদের একটি জায়গায় সেটি স্থাপন করা হবে।
জেলা প্রশাসক বলেন, পাগলা মসজিদ ও ইসলামি কমপ্লেক্সের খরচ চালিয়ে দানের বাকি টাকা ব্যাংকে জমা রাখা হয়। দান থেকে পাওয়া টাকায় ছয়তলাবিশিষ্ট দৃষ্টিনন্দন পাগলা মসজিদ ও ইসলামি কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক খরচ ধরা হয়েছে ১১৫ কোটি টাকা। কাজ শুরু হলে এর পরিমাণ কমবেশি হতে পারে। জেলার বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানায় অনুদান দেওয়ার পাশাপাশি অসহায় ও জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সহায়তা করা হয়ে থাকে এই দানের টাকায়।