সিলেটে শিশু-কিশোরদের সংস্কৃতিচর্চার ‘পাঠশালা’

সিলেটের পাঠশালার সদস্যদের একাংশ। গত বছর আয়োজিত এক উৎসবেছবি: প্রথম আলো

‘স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন দেখাই’ প্রত্যয় নিয়ে ২০০৯ সালে সিলেটে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পাঠশালা’। সেই থেকে অঞ্চলটির শিশু-কিশোরদের শুদ্ধ উচ্চারণ শেখানোর পাশাপাশি সংস্কৃতিচর্চার অন্যতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে এটি। বর্তমানে ২২০ শিশু-কিশোর প্রতিষ্ঠানটির সদস্য হিসেবে যুক্ত আছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

কেবল উচ্চারণই নয়, প্রতিষ্ঠানটিতে আবৃত্তি, ছড়াগান, নাটকও শেখানো হয়। নগরের মির্জাজাঙ্গাল এলাকায় পাঠশালার অস্থায়ী কার্যালয়ে এসব বিষয়ে ক্লাসের পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের নাটকের মহড়া ও প্রশিক্ষণ নিয়মিতভাবে চলছে।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত তিন হাজার শিশু-কিশোর এখানে শুদ্ধ উচ্চারণ শেখার পাশাপাশি নানা সাংস্কৃতিক পাঠ নিয়েছে বলে পাঠশালার পরিচালক ও সিলেটের বাচিকশিল্পী নাজমা পারভীন। তিনি বলেন, পাঠশালার নিজস্ব আয়োজনের পাশাপাশি সিলেটের বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত সাংস্কৃতিক আয়োজনেও তাঁর প্রতিষ্ঠানের শিশু-কিশোরেরা অংশ নেয়। এর বাইরে তাঁরা নিয়মিতভাবে পয়লা বৈশাখসহ বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদ্‌যাপন এবং একুশে ফেব্রুয়ারিতে শিশুদের হাতেখড়ি আয়োজন করে থাকেন।

পাঠশালা–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ২০০৯ সালের পর কেবল করোনা মহামারির সময় ২০২০ সালে তাঁরা সোনামণিদের বর্ণপরিচয় উৎসব ‘হাতেখড়ি’র আয়োজন করতে পারেননি। বাকি বছরগুলোতে ধারাবাহিকভাবে এ আয়োজন করেছেন। এ আয়োজনে তাঁরা এক বা একাধিক ভাষাসংগ্রামীকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানান। ভাষাসংগ্রামীদের হাতেই শিশুদের ‘হাতেখড়ি’ দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত ভাষাসংগ্রামী মনিরউদ্দীন আহমদ, আবুল বশর, ছদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরী ও মো. আবদুল আজিজ এতে অংশ নেন। প্রতিষ্ঠানটি ‘ভাষা আন্দোলনের কালপঞ্জি’ শীর্ষক স্মারক-পুস্তকও প্রকাশ করেছে। শিশু-কিশোরদের পাঠাভ্যাস ও সাহিত্যচর্চা বাড়াতে অনিয়মিতভাবে প্রকাশ করা হয় শিল্প-সাহিত্যের সাময়িকী ‘পাঠশালা’।

সিলেটে ভাষাসংগ্রামীদের দিয়ে শিশুদের প্রতিবছর হাতেখড়ি দেওয়ার আয়োজন করে পাঠশালা
ছবি: ফাইল ছবি

‘পাঠশালা’ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে হাতেখড়ি নেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ও পাঠশালার প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য হৃদিতা পাল। তিনি বলেন, ‘এই যে ভাষাসংগ্রামীদের হাতে আমার “হাতেখড়ি”, এটা জীবনের বড় পাওয়া। মূলত এখান থেকেই বড় কিছু করার, বড় কিছু হওয়ার স্বপ্নের শুরু।’

‘স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন দেখাই’ প্রত্যয় নিয়ে প্রতিষ্ঠিত পাঠশালার স্লোগান ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র, নানানভাবে নতুন জিনিস শিখছি দিবারাত্র’। প্রতিষ্ঠানটি কর্ণধারেরা জানিয়েছেন, শেখানো নয়, শিল্পের প্রতি শিশুদের কৌতূহল তৈরি ও সৃজনশীল আগামী গড়ার দৃপ্ত শপথে পাঠশালা কাজ করছে। বিশ্বায়নের এ যুগে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিচর্চায় শিশু-কিশোরদের আত্মমর্যাদা ও আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তুলতেই তাঁরা কাজ করছেন।

পাঠশালা সূত্রে জানা গেছে, পাঠশালার অনেক সদস্য জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সর্বোচ্চ পুরস্কার পেয়েছে। পাঠশালা নিয়মিতভাবে ঋতুভিত্তিক আয়োজন, অর্থাৎ বর্ষাবরণ, বসন্তবরণ, পিঠা উৎসব, মধুমাসে ফল উৎসব ইত্যাদি করে থাকে। ২৫ মার্চের কালরাত স্মরণে ‘লালযাত্রা’ পাঠশালার আরেকটি নিয়মিত আয়োজন।

নগরের ব্লু-বার্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজ সিলেটের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র অরিত্র রায়ও পাঠশালার সদস্য। প্রতিবছর পাঠশালার ফল উৎসব নিয়ে সে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে জানায়, আম, কাঁঠাল, জাম, কলা, লিচু, লটকনসহ হরেক রকম ফল আর দই, চিড়া, খইয়ের সঙ্গে মেখে কলাপাতায় খেতে খুব মজা লাগে। এভাবে যে সবাই মিলে খাওয়া যায়, তা তার আগে জানা ছিল না। তারা বন্ধুরা সারা বছর এ উৎসবের জন্য অপেক্ষা করে।