‘হেরা আমার লগে কতায় পারব না’, কটূক্তিকে পাত্তা না দিয়ে রিকশা চালান এই নারী

বরিশাল শহরের পাশে চরকাউয়া থেকে লাহারহাটের পথে রিকশাচালান হেলেনা। ২০ নভেম্বর, লাহারহাট, বরিশালছবি: রাজীব আহমেদ

বরিশাল শহরের লঞ্চঘাটের পাশেই একটি খেয়াঘাট। বহু পুরোনো ঘাটটি থেকে কয়েক মিনিট পরপর শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌকা কীর্তনখোলার এপার-ওপার যাত্রী পারাপার করে। ভাড়া পাঁচ টাকা। এক নৌকায় ১৪ জনের বেশি নেওয়া হয় না।

২০ নভেম্বর সকালে বরিশাল থেকে ভোলা যাওয়ার জন্য খেয়াঘাটটিতে গেলাম। উদ্দেশ্য কীর্তনখোলার ওপারে চরকাউয়া যাওয়া। সেখান থেকে সড়কপথে লাহারহাট যাব। তারপর লঞ্চে ভোলা।

চরকাউয়া খেয়াঘাট থেকে বাস, অটোরিকশা, মোটরসাইকেল ও ব্যাটারিচালিত রিকশা লাহারহাট যায়। একটি অটোরিকশা খুঁজছিলাম। এমন সময় দেখলাম এক নারী রিকশাচালক একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা চালিয়ে আসছেন।

কোনো কোনো শহরে এখন একজন-দুজন নারী রিকশাচালক দেখা যায়। কিন্তু বরিশালে আমি দেখিনি। নারীরা চাকরি ও ব্যবসাকে ভালোভাবেই তাঁদের পেশা হিসেবে নিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা পুরুষকে ছাড়িয়ে গেছেন। তবে একান্ত বাধ্য না হলে কোনো নারীকে রিকশা চালাতে দেখা যায় না।

বরিশাল শহরের লঞ্চঘাটের পাশেই চরকাউয়া যাওয়ার খেয়াঘাট। ইঞ্জিনচালিত নৌকায় জনপ্রতি ভাড়া ৫ টাকা। ২৫ নভেম্বর, ২০২৫
ছবি: সাইয়ান

কীর্তনখোলার ওপারে একজন নারী রিকশাচালক দেখে কৌতূহল বাড়ল। ইচ্ছে হলো, তাঁর সঙ্গে কথা বলি। মনে মনে তাঁকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন লেখার পরিকল্পনাও সাজিয়ে ফেললাম। কিন্তু ততক্ষণে নারী রিকশাচালক আমার পাশ দিয়ে রিকশা চালিয়ে অনেক দূরে চলে গেছেন। তাঁকে আর দেখা গেল না। পরিকল্পনাটি বাদ দিতে হলো।

বরিশাল খেয়াঘাট থেকে লাহারহাট কখনো যাইনি। তাই ভাড়া কত, কোন পরিবহনে কত সময় লাগবে, কোন পরিবহন কতটা নিরাপদ—ধারণা ছিল না।

অটোরিকশা খুঁজছিলাম। কিন্তু খেয়াঘাট থেকে অনেকটা দূর হেঁটে যাওয়ার পরও অটোরিকশার খোঁজ পাচ্ছিলাম না। এক প্রবীণ দোকানদারের কাছে জানতে চাইলাম অটোরিকশা কোথায় পাব? তিনি বললেন, ‘একটু খাড়ান। মুই ঠিক কইরা দিই।’

প্রবীণ দোকানদারের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় এলেন সেই নারী রিকশাচালক। নিজেই আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, ‘যাইবেন?’

প্রবীণ দোকানদার আমার পক্ষ থেকে দর-কষাকষি শুরু করলেন। আমি মনে মনে ঠিক করে রেখেছি, ভাড়া যতই হোক, এই রিকশায় যাব।

চরকাউয়া যাওয়ার খেয়াঘাটে একেকটি নৌকায় ১৪ জন করে যাত্রী নেওয়া হয়। কয়েক মিনিট পরপর ছাড়া হয় নৌকা। বরিশাল শহরের লঞ্চঘাটের পাশে। ২৫ নভেম্বর, ২০২৫
ছবি: সাইয়ান

যা-ই হোক, নারী রিকশাচালক ভাড়া চাইলেন ১৫০ টাকা। খেয়াঘাট থেকে লাহারহাট লঞ্চঘাটের দূরত্ব ২২ কিলোমিটারের মতো। এতটা পথে ভাড়া বেশি মনে হলো না। কিন্তু প্রবীণ দোকানদার আমার পক্ষ হয়ে ভাড়া ১০০ টাকার বেশি বলছেন না। পরে ১২০ টাকায় চূড়ান্ত হলো। উঠে বসলাম নারী রিকশাচালকের রিকশায়।

রিকশাটি পুরোনো, সেটা দেখলেই বোঝা যায়। গতিও খুব একটা উঠছে না। হয়তো মোটরের ক্ষমতা কমে গেছে। ধরে নিলাম অনেক সময় লাগবে। এই ফাঁকে নারী রিকশাচালকের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে তাঁর এই পেশায় আশার কারণ জানার চেষ্টা করলাম।

আমি: রিকশা কত দিন চালান?

নারী রিকশাচালক: আইজ দ্বিতীয় দিন।

মাত্র দুই দিনের অভিজ্ঞতার কথা শুনে মনে অনেকটা শঙ্কা ভর করল। তবে স্বস্তির বিষয় হলো, খেয়াঘাট থেকে লাহারহাটের পথের রাস্তা বেশ চওড়া এবং কদাচিৎ তা দিয়ে বাস-ট্রাক চলাচল করে। ফাঁকা রাস্তার এক পাশ দিয়ে নারী রিকশাচালক ভালোই চালাচ্ছিলেন।

আমি: রিকশা চালাতে এলেন কেন?

নারী রিকশাচালক: রাজমিস্ত্রির জোগালির (সহকারী) কাজ করতাম। অনেক কষ্ট ভাই, জান বাইরাইয়া যায়।

আমি: জোগালির কাজে আয় কত ছিল?

নারী রিকশাচালক: দিনে ৭০০ টাকা।

আমি: রিকশা নিজের?

নারী রিকশাচালক: না। ভাড়া আনছি। মালিক দেতে চায় না। দেছে একটা পুরান রিকশা। দেহেন না কী অবস্থা! নতুন ড্রাইভার দেইখা নতুন রিকশা দেতে চায় না।

আমি: জমা কত?

নারী রিকশাচালক: ৩০০ টাকা। পুরান বইলা জমা কম নেয় না।

ব্যাটারিচালিত রিকশার মালিককে দিনে ৩০০ টাকা দিতে হয়, যা জমা নামে পরিচিত। এর মধ্যে বিদ্যুতের খরচের একটা অংশ থাকে। বাকিটা মালিকের। সাধারণ রিকশার জমা ১২০ টাকা।

বরিশালের চরকাউয়া থেকে লাহারহাট যাওয়ার সড়কটি বেশ প্রশস্ত। এই সড়ক দিয়ে বড় যানবাহন খুব বেশি চলে না। এই পথেই রিকশা চালাচ্ছিলেন হেলেনা
ছবি: সাইয়ান

আলাপচারিতায় নারী রিকশাচালক জানালেন, তিনি খেয়াঘাটের কাছেই একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। ভাড়া মাসে তিন হাজার টাকা। তাঁর স্বামী অনেকগুলো বিয়ে করেছেন, সংখ্যা তিনি নিজেও নিশ্চিত না। এ কারণে স্বামীর সঙ্গে থাকেন না।

তাঁর তিনটি মেয়ে। বয়স যথাক্রমে ৮, ১২ ও ১৪ বছর। বড় দুটিকে মানুষের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজে দিয়েছেন। খাওয়া ও পরার বিনিময়ে তারা সেখানে থাকে। বেতন নেই।

ছোট মেয়েটিকে স্কুলে দেননি, বাসায় থাকে। তাকে একটি পুরোনো স্মার্টফোন কিনে দিয়েছেন। চার হাজার টাকা দামে, যাতে মেয়েটির সময় কাটানোর মতো একটা ব্যবস্থা হয়।

নারী রিকশাচালকের সঙ্গে আবার আলাপচারিতায় ফিরলাম।

আমি: মা–বাবা বেঁচে আছে?

নারী রিকশাচালক: বাপ বাঁইচা নাই। বাপ থাকলে কি এইয়া চালাইতে দেতে! ছোডকালে আব্বায় আমাগো দিয়া এগাছ কুডাও দুগাছ করায় নায়। মায় আছে। এক বইনের কাছে থাকে।

বরিশাল অঞ্চলে ‘এগাছ কুডা দুগাছ করায় নায়’ বলতে বোঝায়, তাঁকে দিয়ে একটি খড় সরানোর মতো কাজও করানো হয়নি, অর্থাৎ আদরে রাখা হয়েছে।

আমি: ভাইবোনেরা কী করে?

নারী রিকশাচালক: হেরা সবাই ভালো আছে। আমিই খালি কষ্টে। আমার কপালে সুখ নাই।

আমি: রিকশা চালানো শিখলেন কার কাছ থেকে?

নারী রিকশাচালক: এক লোক আমারে শিখাইছে। হেরে টাহা দিছি। একটা মোবাইলও লইয়া বাড়িত গ্যাছে গিয়া। এরপর আর কল ধরে না।

আমি: আপনার অভিজ্ঞতা তো কম, যাত্রী পান?

নারী রিকশাচালক: আগে বরিশাল শহরে তো রিকশা চালাইছি। এই রোডে (খেয়াঘাট থেকে লাহারহাট) নতুন।

আমি: এই যে রিকশা চালাচ্ছেন, মানুষ কিছু বলে না?

নারী রিকশাচালক: মানুষের কতায় কি প্যাট ভরব?

আমি: পুরুষ রিকশাচালকেরা কটূক্তি করে না?

নারী রিকশাচালক: হেরা আমার লগে কতায় পারব না।

আমি: আপনার রিকশায় মানুষ ওঠে?

নারী রিকশাচালক: না ওডলে চালাই ক্যান। অনেকে তো ভাড়ার চাইয়া বেশি টাহাও দেয়।

আমি: দিন শেষে কত টাকা থাকে?

নারী রিকশাচালক: ৩০০ টাহা জমা দেওয়ার পর ২০০-৩০০ থাহে। নিজের যদি একটা রিকশা থাকত, তাহলে জমার টাহাডা দেওয়া লাগত না। মাইয়া লইয়া খাইয়া-পইরা থাকতে পারতাম।

চরকাউয়া খেয়াঘাটের ব্যস্ততা
ছবি: সাইয়ান

কথায় কথায় লাহারহাট লঞ্চঘাট চলে এল। রিকশা থেকে নেমে নিজের পরিচয় দিয়ে প্রথম আলোতে তাঁকে নিয়ে লেখার অনুমতি চাইলাম। তিনি সহাস্যে সেই অনুমতি দিলেন। ছবি তুললাম, ঠিকানা ও মুঠোফোন নম্বর নিলাম।

ভাড়া দিলাম। প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ভাড়া পেয়ে তাঁর মুখে হাসি।

টার্মিনাল থেকে হাঁক আসছিল, লাহারহাটের লঞ্চ ছেড়ে যাচ্ছে। জোর পায়ে হাঁটা শুরু করলাম। এ সময় মনে হলো, ওই নারী রিকশাচালকের নামই তো জানা হয়নি।

আবার রাস্তায় ফিরে অনেকটা দূর থেকে জানতে চাইলাম, আপনার নাম কী? নারী রিকশাচালক বললেন, ‘হেলেনা’। পুরো নাম কী? উত্তর এল, ওই ‘হেলেনা-ই’।

মলিন পোশাক, রুগ্‌ণ শরীরের হেলেনা রিকশা নিয়ে চলে গেলেন। তাঁর দারিদ্র্যের জীবনে যেমন বাড়তি কিছু নেই, তেমনি নামও বাহুল্যহীন, শুধুই হেলেনা।