কটিয়াদীতে শিশুসন্তানকে নির্যাতন করে বাবা উধাও

শিশু নির্যাতন
প্রতীকী ছবি

ছয় বছরের শিশুসন্তান স্বর্ণা ঘরের সামনে বসে খেলছিল। লাঠি হাতে বাবা ইকবাল মিয়াকে (৩৬) এগিয়ে আসতে দেখে ভীতসন্ত্রস্ত স্বর্ণা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। বাবা এসে ‘তুই কথা কের লাইগা কইছত’ বলেই বেধড়ক পেটাতে থাকেন। এই সময় স্বর্ণা কান্না করে কেবল বলছিল, ‘আর কইতাম না, আর কইতাম না...।’ মেয়ের এমন করুণ আকুতি পাষণ্ড বাবার মন গলাতে পারেনি। চলে ১০ মিনিট ধরে বিরতিহীন শারীরিক নির্যাতন।

শিশুসন্তানের ওপর বাবার এমন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে গত রোজার মাঝামাঝি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী পৌর শহরের শিমুলতলী বাগরাইট মহল্লায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রথম স্ত্রীর ওপর জেদ মেটাতে বিনা কারণে পরিকল্পনা করে ইকবাল এমন অমানবিক কাণ্ড ঘটিয়েছেন। আর ইকবালের পুরো কাজের সহযোগী ছিলেন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী রাবেয়া বেগম (২৮)।

তবে নির্যাতনের ভিডিওটি গতকাল রোববার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ইকবাল ও রাবেয়াকে ধরতে পুলিশ রাতেই ইকবালের বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করেছে। তবে দুজনের কাউকে পাওয়া যায়নি। প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, ফেসবুকে ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর স্বামী-স্ত্রী গা ঢাকা দিয়েছেন।

প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইকবালের গ্রামের বাড়ি বাগরাইট গ্রামে। পেশায় ইলেকট্রিশিয়ান। অনেকটা রগচটা স্বভাবের। তাঁর প্রথম স্ত্রী হালিমা বেগম। হালিমা-ইকবাল মিয়ার দাম্পত্য জীবন ১৫ বছরের। তাঁদের চার সন্তান। হালিমাকে প্রায় প্রতিদিন মারধর করতেন ইকবাল। তাঁর নির্যাতনের শিকার হয়ে হালিমাকে প্রায়ই হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিতে হতো। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে দুই বছর আগে ইকবালকে রেখে সৌদি আরব পাড়ি জমান হালিমা। চার সন্তান থেকে যায় বাবার কাছেই। সবার ছোট স্বর্ণা।

ইকবালের বাড়ির আশপাশের মানুষ জানান, ইকবাল একটি ঘরে গর্ত খুঁড়ে রেখেছেন। অনেক সময় সন্তানদের গর্তের ভেতরে আটকে নির্যাতন করেন। প্রতিবেশীরা এগিয়ে গেলে ক্ষুব্ধ হয়ে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করেন। ঘটনার দিন চিৎকার শুনে প্রতিবেশীরা এসে স্বর্ণাকে ইকবালের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করেন।

ইকবালের স্বজনদের ভাষ্য, হালিমা চলে যাওয়ার পর ইকবাল দ্বিতীয় বিয়ে করেন। প্রবাস থেকে হালিমা প্রতি মাসে সামান্য টাকা পাঠাতেন। তাতে সন্তুষ্ট থাকতেন না ইকবাল। কয়েক মাস আগে থেকে সন্তানদের নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে লালন-পালন করার আগ্রহ দেখান হালিমা। কিন্তু ইকবাল রাজি হননি। হালিমার কাছে ইকবালের দাবি, সন্তানদের লালন-পালন ব্যয় মেটানোর জন্য টাকা বাড়িয়ে দেওয়ার। হালিমা ইকবালের এমন প্রস্তাবে রাজি হননি। এই অবস্থায় হালিমার প্রতি ইকবালের জেদ বাড়ে। ওই জেদ থেকেই স্বর্ণাকে নির্যাতনের পরিকল্পনা করা হয়। নির্যাতনের ঘটনা ১৫ রোজার দিন দুপুরে। ভিডিও পাঠিয়ে হালিমার কাছে টাকা চান ইকবাল। কিন্তু টাকা না দিয়ে মেয়ের নিরাপত্তায় প্রতিবেশীদের সহযোগিতা চান হালিমা।

এদিকে নির্যাতনের ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর সাধারণ মানুষের মনকে নাড়া দেয়। অনেকে ইকবাল ও তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। রাতেই ভিডিওটি পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ রাসেল শেখের দৃষ্টিগোচর হয়। পুলিশ সুপার ভিডিওটি দেখার পর কটিয়াদী থানা-পুলিশকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।

এ বিষয়ে কথা হয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খানজাদা শাহরিয়ার বিন মান্নানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ভিডিওটি আমার নজরে এসেছে। চোখ রাখতে পারিনি। মনটা কেমন করে উঠল। ইকবাল ও রাবেয়াকে শাস্তির আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। আজ বিকেলে আমি পৌর মেয়র শওকত উসমানকে সঙ্গে নিয়ে শিশুটির বাড়িতে যাব।’

কটিয়াদী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাহফুজুর রহমান সিদ্দিকী জানান, রাতেই তাঁরা বাড়িতে যান। তবে অভিযুক্তদের পাননি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিপদ বুঝতে পেরে সন্ধ্যার পর ইকবাল ও রাবেয়া বাড়ি ছেড়ে চলে যান। এখন ঘরে কেবল স্বর্ণা ও আরেক বোন টুম্পা আছে। টুম্পা সাংবাদিকদের জানায়, তার বাবা সব সময় ভাইবোনদের মারধর করে। ঠিকমতো খাইতে দেয় না। সৎমাও মারধর করে।

মুঠোফোন বন্ধ থাকায় ইকবাল ও রাবেয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে ইকবালের ছোট ভাই রাসেল মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘সত্য কথা, আমার ভাই মূলত ভাবির প্রতি রাগ মেটাতে সেই দিন স্বর্ণাকে মারধর করেছিল।’