অসুস্থ প্রাণীর আশ্রয়স্থল মামিয়াত

অসুস্থ কুকুর-বিড়ালের খবর পেলেই মামিয়াত এগুলো সংগ্রহ করে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। খাবার ও সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন।

প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসা থেকে মামিয়াত চৌধুরী গড়ে তুলেছেন প্রাণীদের আশ্রয় ও চিকিৎসাকেন্দ্র। বিয়ানীবাজারের চরখাই বাগবাড়িতেছবি: প্রথম আলো

বাড়ির উঠানে বেশ কয়েকটি খাঁচা। ঘরের বারান্দায় ঝুড়ি। সেগুলোতে ঘুমিয়ে আছে কুকুর-বিড়াল। আবার কয়েকটি কুকুর, বিড়াল খেলছে বাড়ির উঠানে। ঘরের উঠানে অপরিচিত কাউকে দেখলেই খাঁচায় বন্দী অথবা উঠানে থাকা কুকুরগুলো ডাকতে শুরু করে।

সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার চরখাই বাগবাড়ি গ্রামের একটি বাড়ির চিত্র এটি। চারটি কক্ষের বাড়িটিকে হতাহত প্রাণীদের চিকিৎসা ও আশ্রয়কেন্দ্র করেছেন মামিয়াত চৌধুরী নামের এক তরুণী। প্রায় আড়াই বছর ধরে ‘হিরামন অ্যানিমেল শেল্টার অ্যান্ড ফস্টার হোম’ নামের এ প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।

অসুস্থ কুকুর-বিড়ালের খবর পেলেই মামিয়াত সিলেটের বিভিন্ন এলাকা থেকে এগুলো সংগ্রহ করে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। খাবার দেওয়ার পাশাপাশি সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। মমতা ও ভালোবাসা পেয়ে সেগুলোও আর তাঁকে ছেড়ে যেতে চায় না। শুধু কুকুর-বিড়াল নয়, কোথাও বন্য প্রাণী আহত কিংবা ধরা পড়ার খবর পেলেও ছুটে যান মামিয়াত চৌধুরী। প্রয়োজনে চিকিৎসার ব্যবস্থা নিয়ে হস্তান্তর করেন বন বিভাগের কাছে।

মামিয়াত চৌধুরী বিয়ানীবাজার উপজেলার দাহাল গ্রামের বাসিন্দা। বাবা সা‌হিদুল ইসলাম ব‌্যবসায়ী, মা সালমা বেগম গৃহিণী। তিন বোন এক ভাইয়ের মধ্যে তি‌নি সবার বড়। নার্সিং পেশা ছেড়ে কেন এই আশ্রয়কেন্দ্র করলেন? প্রশ্নের জবাবে মামিয়াত বলেন, তিনি গ্রামের বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। এরপর শহরে চলে যান। এসএসসি, এইচএসসির পর করেছেন বিএসসি-নার্সিং কোর্স। ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে পালন করা কুকুর-বিড়াল কিংবা হাঁস-মুরগির প্রতি আলাদা মায়া ছিল তাঁর। বাবা বলতেন, প্রাণীদের মানুষ ক্ষতি না করলে ওরা মানুষের ক্ষতি করে না। বরং তাঁরা মানুষের প্রতি বিশ্বস্ত। বাবার এসব কথা তাঁর মনে গেঁথে গিয়েছিল।

মামিয়াত পড়াশোনা করেছেন সিলেট শহরে ফুফুর বাড়িতে থেকে। সে সময় বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার পথে রাস্তাঘাটে অসুস্থ কিংবা রুগ্‌ণ কুকুর-বিড়াল দেখতেন। সেগুলো দেখে তাঁর মায়া লাগত। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার পথে রাস্তাঘাটে পড়ে থাকা বিড়াল তুলে নিয়ে যেতেন সিলেট শহরের বাসায়। সেগুলোকে সেবাযত্ন করে সুস্থ করে তুলতেন। তাঁকে সব সময় সহযোগিতা করেছেন তাঁর ফুফু খুদেজা ইসলাম চৌধুরী। সেভাবেই চলছিল বিএসসি নার্সিং কোর্স পড়ার আগে পর্যন্ত। এরপর তিনি মনে মনে স্থির করেন প্রাণীদের জন্য কিছু একটা করবেন।

নার্সিং পড়ার সময় মামিয়াত নানাবাড়ি চরখাই বাগবাড়ি গ্রামে ঘুরতে আসেন। নানা-নানি মারা যাওয়ার পর বাড়িটি খালিই পড়ে ছিল। নিজেদের বাড়ি থেকে কাছে হওয়ায় বাড়িটি তাঁর মা–বাবা এ বাড়ি দেখাশোনা করতেন। পরে নানাবাড়িটি প্রাণীদের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য মা–বাবার পরামর্শ নেন তিনি। ২০২১ সালে কাজ শুরু করেন মামিয়াত। বাড়িটিতে প্রথমে তিনটি কক্ষ থাকলেও পরে তিনি আরও একটি কক্ষ তৈরি করেন। তিনটি কক্ষ বিড়াল ও নিজের জন্য এবং একটি কক্ষ অসুস্থ কুকুরের জন্য নির্ধারণ করেন।

মামিয়াতের আশ্রয়কেন্দ্রে গত রোববার পর্যন্ত ছিল বিভিন্ন প্রজাতির ৩১টি কুকুর-বিড়াল। গত ৩১ জানুয়ারি তিনি নিজ এলাকা থেকে অসুস্থ অবস্থায় একটি ভুবন চিল উদ্ধার করেছিলেন। পরে সেটিকে সেবা দিয়ে সুস্থ করে উড়িয়ে দিয়েছেন। এর আগে ২৫ ও ২৬ জানুয়ারি পরপর দুদিনে গোলাপগঞ্জ থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে ধরা পড়া দুটি বনবিড়াল উদ্ধার করে সেগুলো বন বিভাগের মাধ্যমে ছেড়ে দিতেও সহায়তা করেন।

তিনি বলেন, মানুষের সেবা করার জন্য নার্সিংয়ে পড়েছেন। তিনি সে পেশায় এগোননি। কিছুদিন নার্সিংয়ের শিক্ষক হিসেবে পড়িয়েছেন। প্রায় সাত মাস শিক্ষকতা করিয়ে প্রাণীদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলেন এমনটি ধারণা হয় তাঁর। এরপর শিক্ষকতা ছেড়ে পুরোপুরি প্রাণীদের সেবা করবেন বলে মনস্থির করেন। গবাদিপশু পালনের বিষয়ে ছয় মাসের একটি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তবে প্রাণীদের অস্ত্রোপচারের দরকার হলে তিনি প্রাণী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।

মামিয়াত বলেন, তাঁর আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা প্রতিটি প্রাণীর পেছনে একেকটি গল্প আছে। তাঁর আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা ১৬টি কুকুরের মধ্যে পাঁচটি পক্ষাঘাতগ্রস্ত। সেগুলো সামনের পা দিয়ে হাঁটাচলা করতে পারলেও পেছনের দুই পা এবং কোমর টেনে চলে।

১৫টি বিড়ালের মধ্যে পার্সিয়ান জাতের ৫টি বিড়াল রয়েছে আশ্রয়কেন্দ্রে। এর মধ্যে একটি বিড়ালের একটি চোখ নেই। সেটিকে প্রায় এক বছর আগে সিলেটের মিরাবাজার এলাকা থেকে উদ্ধার করেছিলেন তিনি। প্রায় দুই বছর বয়সের ‘চিংকি’ নামের একটি বিড়ালকে তিনি এক মাস বয়স থেকে আশ্রয় দিয়েছেন। বিড়ালটি মামিয়াত ঘর থেকে বের হলেই তাঁর পিছু নেয়। তার পায়ের কাছে ঘুরঘুর করে। তবে মামিয়াত বাড়ির বাইরে বের হলে সেটি আর আসে না।

আশ্রয়কেন্দ্রের খরচ কীভাবে জোগাড় করেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে পড়িয়ে যা আয় করতেন, সেটি থেকে প্রাণীদের চিকিৎসা এবং খাবারের টাকা খরচ করতেন। এখন তিনি অনলাইনে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করেন। পরিবারের কাছ থেকেও সহায়তা পান। এ ছাড়া অনেকে তাঁকে অনুদানও দেন। মাসে তাঁর আশ্রয়কেন্দ্রে দুই বস্তা চাল ও মাংস মিলিয়ে প্রায় ৫০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়।

মামিয়াত চৌধুরী বলেন, প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসা থেকেই তিনি প্রতিষ্ঠানটি করেছেন। এতে নিজে প্রশান্তি পান। ভবিষ্যতে তিনি আশ্রয়কেন্দ্রের পাশাপাশি এটিকে প্রাণীদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল করতে চান।

বিয়ানীবাজার উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের ভেটেরিনারি সার্জন এ কে এম মোক্তাদির বিল্লাহ বলেন, মামিয়াত চৌধুরী প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসা থেকেই এমন কাজ করছেন। এমন ভালোবাসা আজকাল দেখা যায় না। যেকোনো সহায়তার জন্য তিনি প্রায়ই তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।