‘কে জানত, এ বিদায়ই শেষবিদায়’

নৌকাডুবিতে স্বামী জগদীশ চন্দ্র রায়কে হারিয়ে ফুলমতি রানীর বিলাপছবি: প্রথম আলো

কৌশিক আর ছোট্ট রাধিকাকে নিয়ে কতই-না স্বপ্ন দেখতেন জগদীশ! ছেলে-মেয়েরা যা আবদার করত, তা-ই এনে দিতেন। আগলে রাখতেন সব সময়। সেই জগদীশকে আর কাছে পাবে না কৌশিক-রাধিকা, পূরণ করবেন না আর কোনো আবদার। গত রোববার পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৬৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁদেরই একজন মাড়েয়া বটতলী গ্রামের জগদীশ চন্দ্র রায় (৩০)।

শারদীয় দুর্গোৎসবের মহালয়া অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বোদা উপজেলার মাড়েয়া বাজার এলাকার আউলিয়া ঘাট থেকে শতাধিক মানুষ নিয়ে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত ছোট একটি নৌকা বদেশ্বরী মন্দিরের দিকে যাচ্ছিল। ঘাট থেকে নৌকাটি কিছু দূর যাওয়ার পর দুলতে শুরু করে। এ সময় মাঝি নৌকাটি ঘাটে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে নৌকাটি ডুবে যায়। নৌকার যাত্রীদের অনেকেই সাঁতরে তীরে উঠে আসেন। কিন্তু জগদীশ তলিয়ে যান। গতকাল সোমবার স্থানীয় ব্যক্তিরা তাঁর লাশ উদ্ধার করেন। পরিবারের কাছে হস্তান্তরের পর গতকাল সন্ধ্যায় লাশের সৎকার হয়।

আরও পড়ুন

আজ সকালে মাড়েয়া বটতলী গ্রামে জগদীশ চন্দ্রের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে স্বজনদের ভিড়। স্বামীকে হারিয়ে বিলাপ করছেন ফুলমতি রানী। স্বজনেরা তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেও বিলাপ থামছে না তাঁর। তিনি কাঁদছেন আর বলছেন, ‘তোমার ভাই হামাক ছাড়ি গেইল। অ্যালা হামাক কায় দেখিবে গে। ছোয়ালাক ধরিয়া মুই কোনঠে জামো। হামার সব শেষ হয়ে গেইল।’ বলতে বলতে মূর্ছা যান তিনি।

এ সময় ফুলমতির ছোট বোন সীতা রানী ছুটে আসেন। ফুলমতির পায়ে পড়ে কাঁদতে থাকেন তিনি। কিছুক্ষণ পর ধাতস্থ হলে প্রথম আলোর এ প্রতিবেদক তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। সীতা রানী বলেন, ‘জামাইবাবু মজুরি করেই সংসার চালাতেন। সংসারের সুখের জন্য তিনি কঠোর পরিশ্রম করতেন। জামাইবাবু নদীতে ডুবে মারা গেলেন। এখন দিদিদের সংসার কীভাবে চলবে, ভাবতে গেলে চোখে জল আসছে।’

আরও পড়ুন

হই-হুল্লোড় আর দুষ্টুমিতে সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখত শিশু দীপঙ্কর (৩)। সেই বাড়িতে চলছে মাতম। ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় বাবা বাবুল চন্দ্র রায়। প্রলাপ বকতে বকতে বলছিলেন, ‘আমাকে বাবা বলে ডাকার আর কেউ থাকল না।’ আজ সকালে দেবীগঞ্জ উপজেলার শালাডাঙ্গা এলাকার বাবুল চন্দ্র রায়ের বাড়িতে গিয়ে এ দৃশ্য দেখা যায়।
রোববার করতোয়ায় নৌকাডুবির ঘটনায় বাবুল চন্দ্রের ছেলে দীপঙ্করের মৃত্যু হয়েছে। একই দুর্ঘটনায় বাবুলের ভাই রবিন চন্দ্রের স্ত্রী তারা রানী, ছেলে বিষ্ণু, আরেক ভাই কার্তিক রায়ের স্ত্রী লক্ষ্মী রানী মারা গেছেন। এক পরিবারের চারজনের মৃত্যুতে পুরো গ্রাম শোকে স্তব্ধ। দুর্গাপূজা ঘিরে যে বাড়িতে আয়োজন চলছিল, সেই বাড়িতে চলছে মাতম।

স্ত্রীকে হারানো কার্তিক রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহালয়ার অনুষ্ঠানে যেতে নদীর ঘাটে গিয়ে তাদের বিদায় জানিয়ে এসেছিলাম। তখন কে জানত, এ বিদায়ই শেষবিদায়।’

আরও পড়ুন