জরাজীর্ণ ঘরে দুর্বিষহ জীবন

খুলনার কয়রা উপজেলার মঠবাড়ি গ্রামে কয়রা নদীর চরে নির্মিত গুচ্ছগ্রামের জরাজীর্ণ ঘরছবি: প্রথম আলো

জরাজীর্ণ ঘর। ধসে পড়েছে ভিটার মাটি। নেই সুপেয় পানির ব্যবস্থা, চলাচলের রাস্তা ও বিদ্যুৎ-সংযোগ। দরজা-জানালা ভাঙাচোরা। ঘরগুলো বসবাসের অনুপযোগী। কিন্তু বিকল্প না থাকায় এসব ঘরে বাস করতে গিয়ে দুস্থ পরিবারগুলো ভোগান্তি পোহাচ্ছে। এই চিত্র খুলনার কয়রা উপজেলার কপোতাক্ষ নদ ও কয়রা নদীর চরে তিনটি গুচ্ছগ্রামের।

উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বসতভিটা হারানো ৪৫০ পরিবারের পুনর্বাসনের জন্য ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে সাড়ে সাত কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল এই তিনটি গুচ্ছগ্রাম। চার বছর আগে এই গুচ্ছগ্রামে বসবাস শুরু করে ওই পরিবারগুলোর সদস্যরা। কিন্তু নানা অব্যবস্থাপনার কারণে এসব গ্রামে বসবাসের পরিবেশ নেই। দীর্ঘদিন ধরে এসব গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দারা ঘর সংস্কার, সুপেয় পানির ব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ-সংযোগ দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব সমস্যা সমাধানে আজ পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামাল হোসেন জানান, ‘গুচ্ছগ্রামে বিদ্যুৎ-সংযোগের কাজ শুরু করতে কয়রা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে বলা হয়েছে। কয়রার গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দাদের দুরবস্থার বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। আশা করি, খুব দ্রুত এসব সমস্যার সমাধান হবে।’

কয়রা উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প-২–এর আওতায় বিভিন্ন দুর্যোগে গৃহহীন মানুষের একটি ঠিকানার জন্য সাড়ে সাত কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে কয়রার তিনটি ইউনিয়নে ৪৫০টি ঘর নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে কয়রা সদর ইউনিয়নের গোবরা গ্রামে কপোতাক্ষ নদের চর ভরাট করে ২২০টি ঘর, মহারাজপুর ইউনিয়নের মঠবাড়ি গ্রামের কয়রা নদীর চর ভরাট করে ১৭০টি ঘর এবং উপজেলার বাগালী ইউনিয়নের শেওড়াপাড়া গ্রামের কপোতাক্ষ নদের চর ভরাট করে নির্মাণ করা হয় ৬০টি ঘর।

মঠবাড়ি গুচ্ছগ্রামের প্রতিটি ঘর নির্মাণে সরকারের ব্যয় হয় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। তিনটি কমিউনিটি ভবন তৈরির জন্য ২৩ লাখ ৭৯ হাজার টাকা, একেকটি পরিবারের জন্য বৃক্ষ রোপণ ও চুলা নির্মাণে ১ হাজার ৫০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রতিটি পরিবারের জমির দলিল হস্তান্তর করতে ৫০০ টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। এ ছাড়া প্রকল্পের জায়গা ভরাট, নলকূপ স্থাপন, পুকুরের ঘাটলা নির্মাণসহ বিভিন্ন খাতে সাড়ে ৭ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়।

গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা মনজিলা খাতুন জানান, তাঁরা সবাই নদীভাঙনে বসতভিটা হারিয়ে এই গুচ্ছগ্রামে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু এখানকার ঘরগুলোয় আলোর ব্যবস্থা নেই। গোসলখানাগুলো ভেঙে গেছে। ঘূর্ণিঝড় বুলবুল, আম্পান ও ইয়াসের সময় দীর্ঘদিন নদীর পানিতে ডুবেছিল ঘরগুলো। দীর্ঘদিন জোয়ারের পানি ওঠানামা করায় ঘরের মাটি ধুয়ে নদীতে চলে গেছে।

মনজিলা খাতুন আরও বলেন, ‘আমাগে যাবার কোনো জাগা না থাকায় কষ্ট করি গুচ্ছগ্রামে পড়ি আছি। কষ্ট সহ্যি করতি না পারি অনেক লোক চলি গেছে। আমরা এখনো যারা টিকি আছি তাগের দিকি কেউ খেয়াল করে না।’

বসবাসের পরিবেশ না থাকায় এসব গুচ্ছগ্রামের ঘর পাওয়া বেশ কিছু পরিবার অন্যত্র চলে গেছেন। আর যাঁরা এখানে আছেন, তাঁরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, মহারাজপুর ইউনিয়নের মঠবাড়িয়া গুচ্ছগ্রামের ১৭০ ঘরের ১০২টি ঘরই ফাঁকা পড়ে আছে। শেওড়াপাড়া গুচ্ছগ্রামের ৬০টি ঘরের মধ্যে ৪২টি ঘরের মানুষ অন্য স্থানে চলে গেছেন। গোবরা গুচ্ছগ্রামের ২২০টি ঘরের ২২টি ঘরে কেউ বসবাস করেন না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিন গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের সমস্যা একই ধরনের। একটিতেও নেই সুপেয় পানির ব্যবস্থা। সব নলকূপ নষ্ট হয়ে গেছে। বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তার থাকলেও নেই বিদ্যুৎ-সংযোগ। কয়েকবার নদীর জোয়ারের পানিতে ডুবে অধিকাংশ ঘরের ভিটার মাটি সরে গেছে। নেই যোগাযোগের রাস্তা।

শেওড়াপাড়া গুচ্ছগ্রামে বাস করেন জামিলা বেগম। এখানে থাকতে গিয়ে তিনি প্রতিদিন নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ঘরগুলো খুবই জরাজীর্ণ। শীতের মধ্যেও কষ্টে দিন কাটাতে হয়। প্রথম থেকেই এখানে বিদ্যুৎ–সংযোগ নেই, নেই খাবার পানি। ঘরের অবস্থা এতই খারাপ যে এতে থাকার অবস্থা নেই। অন্য কোথায় আশ্রয় পেলে চলে যেতাম।’

মঠবাড়িয়া গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা হালিমাবেগম বলেন, ‘অনেক দূর থেকে খাবার পানি আনতে হয়। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের একটি ট্যাংক থাকলেও তার নিচে ছিদ্র হয়ে পানি পড়ে যাচ্ছে। কয়েক বছর জোয়ারের পানি ওঠানামা করায় ঘরের মাটি ধুয়ে নদীতে চলে গেছে। এখন নদীর তীরে বাঁধ হলেও ঘরে থাকার মতো কোনো পরিবেশ নেই। এর থেকে গ্রামের গরুর ঘরও অনেক ভালো। প্রতিবছর শুধু আশ্বাস পাই কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না। আমরা ঘর ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’

মহারাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, গুচ্ছগ্রামের ঘরগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। সেখানে বহু কষ্ট করে মানুষজন বসবাস করেন। এগুলো মেরামত বা পুনর্নির্মাণের জন্য বারবার বলার পরও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।