খুলনা নগরের শেরে বাংলা রোডের আলকাতরা মিল মোড়ের পশ্চিম পাশে একটি কাঠমিস্ত্রির দোকানে কাজ করেন ৩২ বছর বয়সী আজিজুল। ১০ বছর ধরে আজিজুল সেখানে কাজ করছেন। ওই দোকানে ভ্যানের বডি তৈরির কাজ হয়। প্রতিটি বডি তৈরির জন্য আজিজুল পান ৫০ টাকা করে। সব মিলে দিনে আট থেকে নয়টা ভ্যানের বডি তৈরি করতে পারেন।

আজিজুলদের গ্রামের বাড়ি বটিয়াঘাটা উপজেলার খাড়াবাদ বাইনতলা গ্রামে। তাঁর বাবা শহরের একটি মুদিদোকানে কাজ করতেন। আজিজুলদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা শহরে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে অসচ্ছলতার কারণে ওই পাট চুকিয়ে ফেলতে হয় তাঁকে। এরপর কাঠমিস্ত্রির কাজ শেখেন।

আজিজুল বলেন, ‘যখন শুরু করছি, তখনও ৫০ টাকা এখনো প্রতি ভ্যানে ৫০ টাকা। সপ্তাহে বড়জোর ৫ দিন কাজ হয়। সব মিলিয়ে মাসে ২০-২২ দিন কাজ চলে। যে মাসে কাজে গ্যাপ কম থাকে, সেই মাস ভালো চলে। আসলে আয় দাঁড়ায়ে থাকলেও, ব্যয় বাড়িছে প্লেনের গতিতে। জমানো টাকা নেই। অসুখবিসুখ বা বড় কোনো কিছু হলে ধারদেনা করা লাগে।’

রোজগার না বাড়ার পেছনে অবশ্য মহাজনের হাত দেখেন না আজিজুল। তিনি বলেন, ‘মহাজন মজুরি বাড়াবে বা কি করে! আগে ভ্যানের যে বডি ৫০০ টাকায় বিক্রি করা হতো। এখনো একই দাম। এক ঘনফুট কাঠ লাগে একটা বডি তৈরিতে। সেই কাঠের দাম, লোহার পেরেকের দাম—সবই বেড়েছে। আবার অনেক সময় বাকিটা বেশি পড়ে মহাজনের।’

গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে আজিজুলের কর্মস্থলে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। মাঘের বিকেলে মাথার ওপর ঘুরছে ফ্যান। অমসৃণ কাঠে রায়দা ঘষে ঘষে মসৃণ করছেন তিনি। মাঝেমধ্যে কাঠের কুচি ঝাড়ু দিচ্ছিলেন। রায়দার ধারে কিছু পরপর তেল দিয়ে নিচ্ছিলেন।

কাজ করতে করতেই আজিজুল বলছিলেন, ‘ইদানীং সবকিছুর দাম বেড়ে সমস্যা হয়ে গেল। মাছ প্রায় সময়ই খাওয়া পড়ে। মাসে দুইবার ব্রয়লার মুরগি খাই। আমাদের মতো লোকের মুরগি ছাড়া আর কিবা মাংস খাওয়ার আছে। তিন–চার মাস পর একবার গরুর মাংস কিনতে পারি।’

সংসার চালানোর খরচের হিসাব দিয়ে আজিজুল বলেন, সংসারে প্রতিদিন মাছ–সবজি কেনা লাগে ২০০ টাকার। ১ কেজি চাল লাগে, যার দাম পড়ে ৬৫ টাকা। এক রুমের ঘরভাড়া ৩ হাজার টাকা। এরপর মাসে এক সিলিন্ডার গ্যাস লাগে। গত তিন-চার মাসে গ্যাসের পেছনে বাড়তি ৪০০ টাকারও বেশি লাগছে। পানির বিল এখন প্রতিমাসে ৩০০ টাকা লাগছে। ১ হাজার টাকার বিদ্যুৎ ঢোকালে ২৫-২৬ দিন যায়। সব মিলে খরচ আর খরচ।

দীর্ঘসময় পরিশ্রম করে শরীর বেশ ক্লান্তি আসে আজিজুলের। একটু ভালোমন্দ খাবারের দরকার পড়ে শরীরে। শরীরের ঘাটতি পূরণে প্রতিদিন একটু দুধ আর ডিম খেতেন তিনি। মূলত সন্তানদের জন্যই সেগুলো কিনতেন। এখন নিয়মিত এগুলো কেনা হচ্ছে না।

আজিজুল বলেন, ‘একটু ভালো খাওয়া লাগে। একটা ডিম বা এক গ্লাস দুধ খাওয়া লাগে। সেটা হচ্ছে না। সন্তানদেরও ঠিকমতো ডিম-দুধ খাওয়াতে পারছি না। মেয়েটা ছোট আর ছেলেটা একটা মাদ্রাসায় পড়ে। তার পেছনেও সব মিলিয়ে হাজার পাঁচেক খরচ হয়। আসলে ইনকামে পেরে উঠছি না।’