আঁধারে ‘অন্ধের টেক’

কালিয়াকৈরের সব জায়গায় বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হলেও এখনো অবহেলায় পড়ে আছে ‘অন্ধের টেক’।

গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক এলাকায় ‘অন্ধের টেক’–এ ৪৫টি ঘর। বাসিন্দাদের বেশির ভাগই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী
ছবি: প্রথম আলো

গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক এলাকার একটি জায়গার নাম ‘অন্ধের টেক’। দীর্ঘদিন ধরে সেখানে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের বসবাসের কারণেই এই নাম। ওই টেকে সব মিলিয়ে ৪৫টি ঘর। বাসিন্দাদের বেশির ভাগই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। কালিয়াকৈরের সব জায়গায় বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হলেও এখনো অবহেলায় পড়ে আছে অন্ধের টেক। সেখানে এখনো দেওয়া হয়নি বিদ্যুৎ–সংযোগ।

এই হতাশার শেষ নেই অন্ধের টেকের বাসিন্দাদের। তাঁদের দাবি, ২০ বছর ধরে চেষ্টা করেও তাঁদের ঘরগুলোতে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে পারেননি। অথচ পাশেই বাংলাদেশ বনশিল্প করপোরেশনের স্থাপনায় রয়েছে বিদ্যুতের সব সুযোগ-সুবিধা। নিজেদের অন্ধত্বের কারণেই এমন অবহেলা কি না, এমন প্রশ্নও তুলছেন সেখানকার বাসিন্দারা।

হতাশা ও ক্ষোভ জানিয়ে অন্ধের টেকের বাসিন্দা ও বাংলাদেশ অন্ধ কল্যাণ সমিতির সভাপতি কোরবান আলী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী কইছিলেন প্রত্যেক ঘরে ঘরে আলো জ্বলব। কিন্তু আমাগো ৪৫টা ঘরে গত ২০ বছরে আলো জ্বলেনি। আমরা তো জন্মান্ধ, তাই অন্ধকারে থাকি। বিদ্যুৎ না থাকায় আমাগো বউ–পোলাপাইনও অন্ধকারে জীবন যাপন করতাছে। আমরা চোহে (চোখে) দেহি না, তাই সবাই অবহেলা করে। হের লাইগা বেকেই (সবাই) মনে করে, হেরা চোহে দেহে না, হেগো আলো দিয়া দরকার কী? বিদ্যুতের লাইগা যার কাছেই যাই, হেরাই (তারাই) বাচ্চা পুলাপানের মতো বুঝাইয়া দেয়। আমাগো সামনে বিদ্যুতের ব্যবস্থা কইরা দিব কয়। কিন্তু চইল্যা আইলেই ভুইল্যা যায়।’

প্রধানমন্ত্রী কইছিলেন প্রত্যেক ঘরে ঘরে আলো জ্বলব। কিন্তু আমাগো ৪৫টা ঘরে গত ২০ বছরে আলো জ্বলেনি।
কোরবান আলী, সভাপতি, বাংলাদেশ অন্ধ কল্যাণ সমিতি

অন্ধের টেকের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক এলাকায় একটি পরিত্যক্ত জমিতে ৪৫টি পরিবার ২০০১ সাল থেকে বসবাস করে আসছে। তাদের বেশির ভাগই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ও ভূমিহীন পরিবার।

২৭টি ঘরে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের বসবাস। বাকি ঘরগুলো তাঁদের সন্তানদের। ২০০৩ সালের মার্চ মাসে অন্ধ কল্যাণ সমিতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে বসবাসরত ৪ একর ৫৬ শতাংশ জমি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের বন্দোবস্ত দেওয়ার জন্য আবেদন করে। তখন একটি পক্ষ ওই জমি জবরদখল করতে চাইলে সেখানকার বাসিন্দারা আদালতের দ্বারস্থ হন। আদালত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের পক্ষে একটি স্থিতিশীল আদেশ দেন।

এর পর থেকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা স্থায়ীভাবে সেখানে বসবাস করছেন। দুই যুগের বেশি সময় ধরে সেখানে বসবাস করলেও তাঁরা বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না।

কবে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে, তা–ও তাঁরা জানেন না। তাঁদের বিদ্যুতের সমস্যা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ও গাজীপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম মোজাম্মেল হকও সুপারিশ করেছেন। এরপরও বিদ্যুৎ না পেয়ে একরকম হতাশ হয়ে পড়েছেন তাঁরা।

একসময় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য খুঁটি স্থাপনসহ ট্রান্সফরমারও লাগানো হয়েছিল। তখন একটি পক্ষ সেখানে বাধা সৃষ্টি করেছিল।
আশরাফ উদ্দিন খান, ডিজিএম, মৌচাক পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১

এর মধ্যে ওই জমি নিজেদের দাবি করছে বাংলাদেশ বনশিল্প করপোরেশন। জমি দাবি করে অন্ধের টেকের সমিতির অফিসের পশ্চিম পাশে একটি ঘর করে সেখানে একজন নিরাপত্তাকর্মীকে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। সেই ঘরে বিদ্যুতের মিটার থাকলেও একই স্থানে ৪৫টি পরিবারে বিদ্যুৎ নেই।

সর্বশেষ চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি ওই সমিতির সভাপতি কোরবান আলী বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক জোনাল অফিসের দায়িত্বে থাকা পল্লী বিদ্যুতের জেনারেল ম্যানেজারের কাছে একটি আবেদন করেছেন।

অন্ধ কল্যাণ সামিতির সাবেক সভাপতির স্ত্রী আজিরন বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী বাঁইচা থাকতে বিদ্যুতের লাইগা অনেক চেষ্টা করছে। একবার বিদ্যুতের লোকেরা খুঁটি আনছিল। কিছুদিন সেই খুঁটি ফালাইয়া রাইখা আবার নিয়া চইলা গেছে। বিদ্যুৎ আর পাই নাই। মরার আগে মনে হয় না আমরা বিদ্যুৎ পামু।’

মৌচাক এলাকার বাসিন্দা আইনজীবী রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের প্রধানমন্ত্রী যেখানে ঘোষণা দিয়েছেন একটি ঘরও বিদ্যুৎহীন থাকবে না, সেখানে শিল্প–অধ্যুষিত গাজীপুরের ৪৫টি পরিবার ২০ বছর ধরে বিদ্যুৎ না পাওয়া খুবই দুঃখজনক।

জমির মালিকানা যারই হোক, সেটি আদালত সিদ্ধান্ত দেবেন। কিন্তু তার জন্য এতগুলো পরিবারকে বিদ্যুৎ না দেওয়া মানে প্রতিবন্ধীদের ওপর নির্যাতন করা হচ্ছে।’

অন্ধের টেক এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, টেকের শুরুতেই একটি টিনের বেড়া ও ছাউনির ঘর রয়েছে। সেটি ব্যবহার করছে বাংলাদেশ অন্ধ ব্যবসায়ী কল্যাণ সামিত। ১৯৯১ সালের রেজিস্ট্রেশন করা সমিতির অফিসে কোনো বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই। এর পাশেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের ঘরবাড়ি। তাঁদের ঘরেও বিদ্যুৎ বা মিটার নেই। আনুমানিক ৫০ ফুট দূরেই রয়েছে বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের প্রহরীর আবাসস্থল। তাঁর ঘরে বিদ্যুতের সব ব্যবস্থা রয়েছে। ওই করপোরেশনের প্রহরী হারুন অর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ঘরে বিদ্যুৎ থাকলেও অন্ধদের ওখানে কেন বিদ্যুৎ পাচ্ছে না, সেটি তাঁর জানা নেই।

মৌচাক পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১–এর উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) আশরাফ উদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, একসময় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য খুঁটি স্থাপনসহ ট্রান্সফরমারও লাগানো হয়েছিল। তখন একটি পক্ষ সেখানে বাধা সৃষ্টি করেছিল এবং খুঁটি–ট্রান্সফরমার তুলে ফেলে, তাই বিদ্যুৎ–সংযোগ হয়নি।