এস এম সুলতানের শিষ্য তিনি

চারুকুঠিতে ছবি আঁকছেন শিল্পী ধর্মদাস মল্লিক। তাঁরই পাশে ছবি আঁকছে শিশুরা। সম্প্রতি নড়াইল সদর উপজেলার শিমুলিয়া গ্রামেছবি : প্রথম আলো

বাড়ির নাম ‘চারুকুঠি’। বাড়ির পুরোনো কাঠের দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে—দেয়ালে ঝোলানো সারি সারি ছবি। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে ওঠার পথেও ঝুলছে একটার পর একটা ক্যানভাস। ছাদের একচালাতেও একই দৃশ্য—রং, রেখা আর কল্পনার মেলায় সাজানো এক জীবন্ত সংগ্রহশালা। সব ছবিতেই যেন ভেসে ওঠে বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের ছাপ। দেয়ালে ঝোলানো ছবির পাশে রাখা টেরাকোটা, ছোট ছোট ভাস্কর্য আর গ্রামবাংলার পুরোনো তৈজসপত্র। 

সম্প্রতি ওই বাড়িতে গেলে বাড়ির মালিক ধর্মদাস মল্লিক বলেন, ‘বাড়িজুড়ে আমার আঁকা শতাধিক ছবি টাঙানো আছে। জায়গা না থাকায় এক হাজারের বেশি ছবি টাঙাতে পারিনি। অনেক ছবি বৃষ্টির ছিটায় নষ্ট হচ্ছে, কিছু পড়ে থেকে ক্ষয়ে যাচ্ছে। রাখার জায়গার সংকটে বড় ছবি আঁকতেও পারছি না।’  

ধর্মদাস মল্লিকের বাড়ি নড়াইল সদর উপজেলার শিমুলিয়া গ্রামে। তিনি চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের শিষ্য। শিল্পমহলে তিনি পরিচিত ডি ডি মল্লিক নামে। তাঁর বাবার নাম সরোজ মল্লিক, মায়ের নাম সুমিত্রা মল্লিক। ঢাকায় দুই দশকের বেশি সময় কাটিয়েছেন চিত্রশিক্ষা, প্রদর্শনী ও পেশাগত কাজে। খুলনা আর্ট কলেজ থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের চারুকলা ইনস্টিটিউট, নারায়ণগঞ্জের চারুকলা ইনস্টিটিউট এবং সর্বশেষ ঢাকার ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ থেকে এমএফএ (চারুকলায় স্নাতকোত্তর) ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। তাঁর আঁকা ছবি প্রদর্শিত হয়েছে দেশ-বিদেশে। 

ধর্মদাসের অবৈতনিক পাঠশালা

সেদিন ছাদের একচালার নিচে ছবি আঁকছিলেন ডি ডি মল্লিক। তাঁর তুলি ঘুরছিল ক্যানভাসে, গ্রামবাংলার চিরচেনা দৃশ্য ফুটে উঠছিল ধীরে ধীরে। চারপাশে শিশু-কিশোরেরা যার যার মতো ছবি আঁকছে। কেউ আঁকা শেষ করে দৌড়ে গিয়ে গুরুকে দেখাচ্ছে। 

প্রতি শুক্রবার সকালে দূরদূরান্ত থেকে অন্তত অর্ধশত শিক্ষার্থী আসেন তাঁর কাছে ছবি আঁকা শিখতে। এক টাকাও ফি নেন না তিনি। বিনা মূল্যের এই শিল্পবিদ্যালয়ের তিনি নাম দিয়েছেন ‘চারুকুঠি শিল্পালয়’। ২০২০ সাল থেকে চলছে এই পাঠশালা। 

ধর্মদাস বলেন, ‘ঢাকায় থাকার সময় আমার একটি পাঠশালা ছিল, যেখানে নামমাত্র বেতনে সবাই ছবি আঁকা শিখত। একসময় মনে হলো শহরের কংক্রিট জীবনে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম, গুরু সুলতানের মতো আমিও গ্রামে ফিরে শিশু-কিশোরদের বিনা পয়সায় শেখাব। সেই ভাবনা থেকেই চারুকুঠির যাত্রা শুরু।’ 

গুরু সুলতানের কাছ থেকে যেভাবে ছবি আঁকা শিখেছিলেন ধর্মদাস, সেভাবেই শিশুদের শেখানোর চেষ্টা করেন তিনি। চারুকুঠি তাঁর কাছে শুধু আঁকার জায়গা নয়, প্রকৃতি ও জীবনের পাঠশালা। তিনি বলেন, ‘শিশুদের মাটির গন্ধ, সূর্যের তাপ আর বৃষ্টির ছোঁয়া অনুভব করাতে হবে। এখানে তাঁরা শুধু ছবি আঁকা শেখে না, চাষও করে, ফসল ফলায়, মাছের পোনা ছাড়ে। প্রতি শনিবার ‘এসো কাজ শিখি’ নামে বিশেষ সেশন হয় চারুকুঠিতে, যেখানে বাগান পরিচর্যা, জীববৈচিত্র্য বোঝা ও প্রকৃতিকে জানার সুযোগ পায় শিক্ষার্থীরা।’ 

প্রতিবাদের ভাষা খুঁজতে ছবি আঁকা

বড় শিল্পী হবেন—এমন স্বপ্ন নিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করেননি ধর্মদাস মল্লিক। শুরুতে তাঁর আঁকা ছিল নিঃশব্দ প্রতিবাদের ভাষা। একবার এক প্রতিবেশী তাঁর একটি কবুতর মেরে ফেলেন। সেই অন্যায় গভীর দাগ কেটেছিল কিশোর ধর্মদাসের মনে। ব্যথিত মনে তিনি বাড়ির মাটির দেয়ালে আঁকলেন মৃত কবুতরের ছবি, নিচে লিখলেন, ‘জীব হত্যা মহাপাপ, নরকে গমন।’ সেখান থেকেই ছবি হয়ে ওঠে তাঁর প্রতিরোধের হাতিয়ার। গ্রামের অন্যায়–অবিচারের প্রতিবাদ জানাতেন রং ও রেখায়। 

তবে তাতেই তৃপ্তি পাননি ধর্মদাস। শুধু প্রতীক নয়, মানুষের মুখও তিনি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন ক্যানভাসে। স্থানীয় কয়েকজন শিল্পীর কাছে কিছুটা শেখেন; কিন্তু মন ভরেনি তাঁর। ঠিক তখনই এক মামাতো ভাই জানান, নড়াইলে নাকি এক ‘বৃদ্ধ মানুষ’ আছেন, যাঁর কাছে গেলে অনেক কিছু শেখা যাবে। সেই ‘বৃদ্ধ’ আর কেউ নন, চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান। ধর্মদাস স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, ‘প্রথমবার গিয়ে গুরুর সঙ্গে দেখা হয়নি। বলা হয়েছিল পরদিন যেতে। দ্বিতীয়বার ১৪ কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা হলো। তাঁর আঁকা বিশাল মানবমূর্তি দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, এমনটাই তো আমি আঁকতে চাই! সেদিন থেকেই শুরু হয় গুরুর কাছে আমার সাত বছরের শেখা। জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি সেটিই।’ 

দারিদ্র্যকে সঙ্গী করে পথচলা

দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করেই বড় হয়েছেন ধর্মদাস। বাবা ছিলেন সংসারের প্রতি উদাসীন; অভাবের সংসারটিকে আগলে রেখেছিলেন মা-ই। অভাবের দিনে বিল থেকে তুলে আনা ঢ্যাপ, শালুক আর আলু ফল—এই ছিল তাঁদের নিত্য আহার। ছোটবেলা থেকেই নানা ধরনের কাজ করেছেন ধর্মদাস। একসময় স্কুলের বেতন দিতে না পারায় পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায় তাঁর। তখন এলাকার রায়বাবুদের বাড়িতে কাজ নেন তিনি। তাঁর পড়ার আগ্রহ দেখে ছোট রায়বাবু নিজেই পরীক্ষার ফি দিয়ে দেন। পরে কাজ করে সেই টাকা শোধ করেন ধর্মদাস। 

রায়বাবুদের বাড়ির পরিবেশ ছিল শিক্ষার অনুকূল। সেখানে যাঁরা কাজ করতেন, তাঁরাও পরীক্ষার সময় নিজেদের সঞ্চিত টাকা তুলে দিয়েছিলেন ধর্মদাসের হাতে, যাতে ছেলেটা পরীক্ষায় বসতে পারে। দারিদ্র্যের টানাপোড়েন থামেনি তখনো। সুলতানের কাছে ছবি শিখতে তিনি প্রতিদিন ১৪ কিলোমিটার পথ হেঁটে যেতেন, আবার ফিরতেন। এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন গুরুর বাড়িতেই থেকে। 

ধর্মদাস বলেন, ‘ম্যাট্রিক পাসের পর আর্ট কলেজে ভর্তি হতে গিয়ে দেখি, প্রচুর খরচের বিষয়। বাবা রাজি ছিলেন না; কিন্তু আমার জেদের কাছে শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করেন। তিনি তাঁর আউশ ধানের জমি, গরু-ছাগল, এমনকি বাড়ির গাছপালাও বিক্রি করে আমাকে টাকা দিয়েছিলেন। আমার এক বউদি ছিলেন, তিনি ডিম বিক্রি করে টাকা দিতেন আমার হাতে। আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী—সবাই যে যেভাবে পেরেছেন সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন।’ 

এ কথা বলতে বলতে চোখ ভিজে আসে ধর্মদাসের। বাবার সেই ত্যাগ তাঁকে আজ যেখানে এনে দাঁড় করিয়েছে, তা দেখে যেতে পারেননি বাবা। চোখ মুছতে মুছতে ধর্মদাস বলেন, ‘আজ সেই জমি, গাছপালা আর পশুপাখি সবই আমার হয়েছে। শুধু বাবা নেই।’ 

আড়াই লাখেও বিক্রি হয়েছে একটি ছবি

খুলনা আর্ট কলেজে পড়াকালীন পড়াশোনা চালাতে নিজের আঁকা ছবি বিক্রি শুরু করেন ধর্মদাস। সুলতানের মতো তিনিও নিজ হাতে তৈরি করতেন ক্যানভাস, রং ও তুলি। আর্থিক কারণে এগুলো বিক্রিও করতেন। ধীরে ধীরে বাড়ে তাঁর পরিচিতি। তাঁর ছবি প্রদর্শিত হয় ঢাকার গ্যালারি, শেরাটন ও সোনারগাঁও হোটেলে, এমনকি কলকাতায়ও। অনেক ছবি বিক্রি হয়েছে বিদেশে। 

ধর্মদাস বলেন, ‘৫০ টাকা থেকে শুরু করেছিলাম, আড়াই লাখ টাকায়ও ছবি বিক্রি করেছি। শহরে থাকলে হয়তো বিভিন্ন জায়গায় ছবি প্রদর্শন করতে পারতাম, বেশি বিক্রি হতো; কিন্তু আমি চেয়েছি মাটির কাছাকাছি থাকতে, শিল্পকে মানুষের মধে৵ ছড়িয়ে দিতে। আমি একদিন থাকব না; কিন্তু আমার শিল্প যেন বেঁচে থাকে—সেই চেষ্টাই করছি।’ 

ঐতিহ্য সংরক্ষণের স্বপ্ন

ধর্মদাসের স্বপ্ন—আর্থিক সহযোগিতা পেলে শিমুলিয়ায় তাঁর অসমাপ্ত বাড়িটি একদিন সমাপ্ত হবে। বাড়িজুড়ে থাকবে তাঁর আঁকা ছবি, যা মানুষ ঘুরে ঘুরে দেখবে। একটি কক্ষে ঠাঁই পাবে হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ পেশা, সরঞ্জাম ও গল্প, যা দেখে নতুন প্রজন্ম চিনবে নিজের শিকড়। 

এই স্বপ্নপূরণে এগিয়ে এসেছেন তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী জাতিসংঘের দুই কর্মকর্তা। তাঁরা প্রায় ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে শিমুলিয়া গ্রামে দুই খণ্ড জমি কিনে দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে সেই জমিতে চাষাবাদ করেন ধর্মদাস মল্লিক। তাঁর পাঠশালা ঘুরে শিল্পপ্রেমী এক বিচারপতি দিয়েছিলেন লাখ টাকা। মাঝেমধ্যে অন্য শুভাকাঙ্ক্ষীরাও সহযোগিতা করেন। জমি থেকে আসা ফসলের টাকা ও এসব সহায়তায় চলছে তাঁর শিল্পবিদ্যালয় ‘চারুকুঠি শিল্পালয়’। 

ধর্মদাস বলেন, ‘ঢাকায় যেসব জায়গায় ছবি প্রদর্শন করতাম, সেখানে দিনে দু-তিনটি ছবিও বিক্রি হতো। লাখ টাকা আয় ছিল। গ্রামে ফিরে আসার পর আর তেমনটা হয় না। তবে শুভাকাঙ্ক্ষীদের মাধ্যমে মাঝেমধ্যে কিছু বিক্রি হয়। ছবি বিক্রি আর চাষবাস করে যা আয় হয়, তা দিয়েই যতটুকু সম্ভব করছি। আমি কখনোই টাকার পেছনে ছুটিনি। যদি টাকার পেছনে ছুটতাম, আজ ঢাকায় গাড়ি-বাড়ি থাকত, চাকচিক্যের জীবন কাটাতাম; কিন্তু আমি সব সময় স্বপ্নকেই প্রাধান্য দিয়েছি। তাই শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে এসেছি।’ 

বেঁচে থাকতে শিল্পীদের কদর হয় কমই, মৃত্যুর পরেই যেন দাম বাড়ে—এই তিক্ত বাস্তবতা জানেন ধর্মদাস। তবু থেমে থাকেননি তিনি। দিনরাত ছুটে চলেছেন নিজের স্বপ্নপূরণের পথে। তাঁর আশা, ‘একদিন এই স্বপ্ন পূরণ হবেই—যদি সবার সহযোগিতা মেলে।’