সন্ধ্যা নামতে তখনো দেরি। এর আগেই মেলার প্রবেশমুখে দর্শনার্থীদের বেশ বড় জটলা। পাঠক-দর্শনার্থীদের এই সারির দৈর্ঘ্যও কম নয়। ভিড় ঠেলে মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া নাফিজা নওরীনের কিছুটা সময় যেমন লেগেছে, তেমন ঝক্কিঝামেলাও পোহাতে হয়েছে। তবে তা নিয়ে বিরক্তির ছাপ ছিল না চেহারায়। প্রিয় লেখকের প্রকাশিত নতুন বই সংগ্রহের তর যেন সইছিল না তাঁর। তাই মেলা প্রাঙ্গণে ঘোরাঘুরি না করে সোজা চলে যান বইয়ের স্টলে। কিনে নেন আগে থেকে পছন্দ করা দুটি উপন্যাস।
গতকাল বুধবার বিকেল সাড়ে পাঁচটায় এই দৃশ্য দেখা যায় চট্টগ্রাম নগরের সিআরবির শিরীষতলায় অমর একুশে বইমেলায়। নাফিজা নওরীনের সঙ্গে কথা হয় প্রথমার স্টলের সামনে। সেখান থেকে নেন আসিফ নজরুলের নতুন উপন্যাস ‘আমি আবু বকর’ আর বিশ্বজিৎ চৌধুরীর ‘অভিযুক্ত’। যখন বই সংগ্রহ করছিলেন, তখন স্টলে বসা ছিলেন লেখক বিশ্বজিৎ চৌধুরী। প্রিয় লেখকের অটোগ্রাফ নিতে ভুল করেননি তিনি। পছন্দের বই, সঙ্গে প্রিয় লেখকের অটোগ্রাফ, তাতে নাফিজা নওরীনের আনন্দ বেড়ে যায় বহুগুণ।
নাফিজার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে সেটিরই প্রকাশ পেল। প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রামে বইমেলা শুরু হয়েছে বেশ কয়েক দিন হয়ে গেছে। কিন্তু ক্লাস-পরীক্ষাসহ নানা চাপ ও কাজে আসা হয়নি। বন্ধের দিন হওয়ায় গতকাল (বুধবার) মেলায় আসার সুযোগ হারাননি। প্রিয় লেখকের সইসহ বই নিয়েছেন। বেশ খুশি লাগছে।
শুধু নাফিজা নওরীন নন, তাঁর মতো উচ্ছ্বাস ছিল পাঠক, লেখক, প্রকাশকসহ সবারই। গতকাল মেলা প্রাঙ্গণে তিলধারণের ঠাঁই ছিল না। বইমেলায় প্রতিবছর এই দিনের অপেক্ষায় থাকেন পাঠক, লেখক প্রকাশকসহ সবাই। পাঠক-দর্শনার্থীর ভিড়ে মেলার বেচাবিক্রি ছিল অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশ জমজমাট।
গতকাল ছিল মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। মেলার সব আকর্ষণ থাকে এই দিন ঘিরে। সকালেই পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত ছিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন আয়োজিত বইমেলা। সকালে ভিড় কিছুটা কম থাকলেও বিকেল থেকে দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। সময় গড়াতেই তা বাড়তেই থাকে।
প্রাণের মেলায় গতকাল কে আসেননি! শিশু-কিশোর থেকে তরুণ-তরুণী। আবার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ছুটে আসেন অনেকেই। বইয়ের স্টলের সামনে পাঠকের জটলা, ছিল লেখক-পাঠকের আড্ডা।
চট্টগ্রামের বইমেলায় বিক্রি নিয়ে শুরু থেকে আক্ষেপ ছিল প্রকাশকদের। পাঠকের স্রোতে সে আক্ষেপের অনেকটাই ঘুচেছে। এত দিনের বই বিক্রির খরা কিছুটা হলেও কাল কেটেছে। যদিও দর্শনার্থীদের ভিড় অনুযায়ী আরও বেশি বেচাকেনার প্রত্যাশা ছিল তাঁদের। তারপরও যা বিক্রি হয়েছে, তাতেই খুশি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।
বইয়ের স্টল ঘুরে আর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এবারের মেলায় উপন্যাস আর প্রবন্ধ বইয়ের কাটতি বেশি। বিক্রির তালিকায় ছিল কিশোরদের থ্রিলারধর্মী বইও।
প্রথমা প্রকাশনের কর্মকর্তা মো. ইরফাতুর রহমান পাঠকদের চাহিদা অনুযায়ী বই খুঁজে দিতে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন। এর ফাঁকে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অন্যান্য দিনের তুলনায় গতকাল মানুষের সমাগম হয়েছে অনেক বেশি। বেশ ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। ক্রেতার সংখ্যাও বেড়েছে। প্রায় সব ধরনের বই কমবেশি বিক্রি হচ্ছে। তবে উপন্যাস আর প্রবন্ধের বইগুলোর কাটতি অনেক।
ইউপিএলের বিক্রয় নির্বাহী শংকর দাশ প্রথম আলোকে বলেন, এবারের মেলায় দর্শক থাকলেও বিক্রি তেমন ছিল না। প্রত্যাশা অনুযায়ী বিক্রি না হওয়ার হতাশা গতকাল অনেকটাই কেটে গেছে।
মেলায় দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়লেও ব্যবস্থাপনা নিয়ে হতাশ লেখক-পাঠকেরা। মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশমুখের সামনের সড়কের দুই পাশে বসেছে চটপটিসহ নানা ধরনের অস্থায়ী দোকান। সেখানে বিভিন্ন রকমের পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। তাতে মেলার সৌন্দর্য অনেকটাই ব্যাহত হয়েছে।
লেখক বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মেলায় প্রচুর দর্শক এসেছেন। বিক্রিও ভালো। কিন্তু ব্যবস্থাপনায় নানা ত্রুটি রয়ে গেছে। এগুলো দূর করতে হবে।
মেলা প্রাঙ্গণে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন লেখক মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম। তিনি বলেন, মেলায় এত বেশি মানুষ হয়েছে, তা বেশ আশাজাগানিয়া। সবাই হয়তো বই কিনছেন না। কিন্তু কেউ কেউ তো বই সংগ্রহ করছেন। অন্যরাও সামনের দিনে বই নেবেন। এই আশা করা যায়।