মাগুরায় বিরোধ বেড়েছে আওয়ামী লীগে, মামলার চাপে কোণঠাসা বিএনপি

অভ্যন্তরীণ বিরোধ মিটিয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকাই আওয়ামী লীগের চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে দ্বিধাবিভক্ত বিএনপি এক দশক ধরে উন্মুক্ত মাঠে সমাবেশ করতে পারেনি। 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে মাগুরা আওয়ামী লীগ। জেলায় দলটির সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত হলেও গত পাঁচ বছরে নানা কারণে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। নেতাদের মধ্যে দৃশ্যমান বিরোধ না থাকলেও দুজন সংসদ সদস্যকে কেন্দ্র করে তৃণমূলে বিরোধ বেড়েছে। গত পাঁচ বছরে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিরোধের বিষয়টি স্পষ্ট হয়। অভ্যন্তরীণ বিরোধ মিটিয়ে নির্বাচনের আগে ঐক্যবদ্ধ থাকাই এখন আওয়ামী লীগের চ্যালেঞ্জ।

অন্যদিকে মামলার চাপে কোণঠাসা জেলা বিএনপি। দীর্ঘদিন ধরে মাগুরায় দলটির অবস্থা নড়বড়ে। রয়েছে কোন্দলও। এক দশক ধরে উন্মুক্ত মাঠে সমাবেশ করতে পারেননি নেতা-কর্মীরা। দলীয় কার্যালয়ে প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া সীমার মধ্যে তাঁদের কর্মসূচি পালন করতে হয়। ২৮ অক্টোবরের পর থেকে দলীয়ভাবে আর মাঠেই নামতে পারেনি দলটি। নির্বাচন সামনে রেখে নিজেদের মতো করে সমর্থন বাড়ানোর চেষ্টা করছে জাতীয় পার্টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ সমমনা দলগুলো।

মঞ্চে ঐক্য, ভেতরে অস্বস্তি

ভোটের রাজনীতিতে তিন দশক ধরে জেলার দুটি আসনে আধিপত্য ধরে রেখেছে আওয়ামী লীগ। ১৯৯১ সালের পর ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ’ চারটি সংসদীয় নির্বাচনের তিনটিতেই জিতেছেন দলের প্রার্থীরা। গত বছরের ১৪ মে সম্মেলনে আ ফ ম আবদুল ফাত্তাহ সভাপতি ও পঙ্কজ কুমার কুণ্ডু সাধারণ সম্পাদক হন। চলতি বছরের এপ্রিলে অনুমোদন পায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি। এ ছাড়া সম্মেলনের মাধ্যমে উপজেলা ও পৌর কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে সংসদ সদস্যের অনুসারীদের আধিপত্যের কারণে তৃণমূলের পক্ষ তৈরি হয়েছে। যুবলীগ ছাড়া সহযোগী সংগঠনগুলোর হালনাগাদ কমিটি আছে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, মাগুরা-১ (সদর-শ্রীপুর) আসনের সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখর ও মাগুরা-২ (মহম্মদপুর-শালিখা-সদর) আসনের সংসদ সদস্য বীরেন শিকদারকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন এলাকায় দুটি করে পক্ষ তৈরি হয়েছে। এক পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সংসদ সদস্যের অনুসারীরা, অন্য পক্ষে আছেন তাঁদের প্রতিপক্ষ দলের নেতা-কর্মীরা। ২০১৯ সালের চারটি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তিনটিতেই হারেন নৌকার প্রার্থীরা। ২০২২ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও ১১টিতে ধরাশায়ী হয় আওয়ামী লীগ। কোনো কোনো এলাকায় ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীরা জনপ্রতিনিধিদের সমর্থনও পান। 

মাগুরা-২ আসনের প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত। সংসদ সদস্য বীরেন শিকদার ছাড়াও বেশ কয়েকজন নির্বাচন করতে চান। তাঁদের মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা এস কে নুরুজ্জামান, শিক্ষা ও মানবসম্পদবিষয়ক সম্পাদক শরীফ উদ্দিন উল্লেখযোগ্য। সর্বশেষ ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান দলের এটিসহ তিনটি আসনের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। 

বীরেন শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় নির্বাচন আর জাতীয় নির্বাচন এক নয়। নির্বাচনের আগে এসব সমস্যার পুরোটা না হলেও বেশির ভাগই সমাধান হয়ে যাবে।

দলীয় সূত্র জানায়, এক দশকের বেশি সময় ধরে জেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনে সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামানের দাপট বেশি। এখানে এত দিন মনোনয়নপ্রত্যাশী কেউ প্রকাশ্যে আসেননি। কিন্তু গত শনিবার ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান দলীয় মনোনয়ন ফরম কেনায় এলাকায় বেশ আলোচনা হচ্ছে। সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে শ্রীপুরে একটি পক্ষ সক্রিয়। যাঁদের অনেকে মনে করেন, সংসদ সদস্য ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন না করে কোণঠাসা করে রেখেছেন। যদিও সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ কুমার কুণ্ডু প্রথম আলোকে বলেন, পাওয়া না-পাওয়া নিয়ে অনেকের হতাশা থাকতে পারে। জাতীয় নির্বাচনে দলের বিরোধিতা করার সুযোগ নেই। এই প্রশ্নে আওয়ামী লীগ এক ও ঐক্যবদ্ধ। 

সাকিবের মনোনয়ন ফরম কেনার বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ফ ম আবদুল ফাত্তাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সে (সাকিব আল হাসান) কখনো জনগণের সঙ্গে মাঠে কাজ করেছে বা কোনো দলের রাজনীতি করেছে বলে তো শুনিনি। নেত্রী ভালো বুঝবেন কাকে মনোনয়ন দিলে ভালো হয়, তাঁর কাছে সব তথ্যই আছে।’

মামলার চাপে কোণঠাসা বিএনপি

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের পর থেকে আহ্বায়ক কমিটি দিয়েই চলছে জেলা বিএনপির রাজনীতি। সর্বশেষ ২০১৯ সালে আলী আহমেদকে আহ্বায়ক ও আখতার হোসেনকে সদস্যসচিব করে ৩৩ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্র। মহম্মদপুর, শালিখা ও দক্ষিণ মাগুরা ইউনিটে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হলেও সদর, শ্রীপুর ও মাগুরা পৌর ইউনিট একজন নেতা দিয়েই চলছে। ২০২০ সালের প্রথম দিকে সদর, শ্রীপুর ও মাগুরা পৌরসভায় কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয় জেলা বিএনপি। তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের ভোটে পৌর ইউনিটের আহ্বায়ক হিসেবে মাসুদ হাসান খান ও সদর উপজেলায় কুতুব উদ্দিন এবং শ্রীপুর উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব হিসেবে মুন্সী রেজাউল ইসলাম নির্বাচিত হন। কিন্তু এরপর কমিটির আকার বাড়েনি।

মাসুদ হাসান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দল অনেক মানুষকে নিয়ে হয়। কিন্তু এখানে আমি একা। দলীয় কর্মসূচিতে অনেকে অংশ নিচ্ছে, কিন্তু সাংগঠনিক কোনো কার্যক্রম নেই। এ ক্ষেত্রে আমরা সাবেক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি।’

সম্মেলনের বিষয়ে জেলা বিএনপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, সম্মেলন আয়োজন করতে নেতা-কর্মীদের জড়ো করতে হয়। গত কয়েক বছরে আওয়ামী লীগ ও পুলিশ প্রশাসন তাঁদের সেই জায়গাও দেয়নি।

বিএনপির নেতারা বলছেন, ক্ষমতাসীনেরা কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ার পাশাপাশি গায়েবি মামলা দিয়ে নেতা-কর্মীদের কোণঠাসা করে রেখেছে। ২০১৪ সাল থেকে মাগুরায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের নামে ৪৫টির বেশি মিথ্যা ও গায়েবি মামলা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের পর মামলা হয়েছে পাঁচটি। বিএনপির ১২ জনের বেশি নেতার বিরুদ্ধে ২০টির বেশি করে মামলা আছে।

জেলা জাতীয়তাবাদী আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহেদ হাসান বলেন, মাসে আদালত চলে ২২ দিন। এর মধ্যে বিএনপির নেতা-কর্মীদের অন্তত ১৫ দিন আদালতে হাজিরা দিতে হয়। গত কয়েক মাসে ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদেরও মামলায় আসামি করা হয়েছে। মামলার কারণে নেতা-কর্মীদের ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবার, স্বাভাবিক চলাফেরা সবকিছু বাধাগ্রস্ত হয়ে গেছে।

মামলা-হামলার চাপের মধ্যেও জেলা বিএনপি দুটি ধারায় বিভক্ত। এক পক্ষের নেতৃত্বে আছেন ২০১৮ সালে মাগুরা-১ আসনে মনোনয়ন পাওয়া জেলা বিএনপির সদস্য মোনোয়ার হোসেন খান এবং মাগুরা-২ আসনের প্রার্থী বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী। অন্য পক্ষের নেতৃত্বে আছেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আলী আহমেদ।

আলী আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এটা বিরোধ নয়, প্রতিযোগিতা। স্থানীয় নেতৃত্ব নিয়ে প্রতিযোগিতা থাকতে পারে। তাঁরা সবাই দল ও নেতা তারেক রহমানের অনুগত। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে দল যাঁকে মনোনয়ন দেবে, তাঁরা তাঁর পক্ষে কাজ করবেন।