লাশ যাতে শনাক্ত না করতে পারে, সে জন্য হত্যার পর শরীর থেকে মাংস কেটে আলাদা করেন খুনিরা

নিহত কলেজছাত্র সিবলি সাদিক
ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রামের রাউজানে কলেজছাত্র সিবলি সাদিককে (১৯) হত্যার পর টুকরা টুকরা করে কেটে শরীর থেকে মাংসও আলাদা করে ফেলছিলেন খুনিরা। লাশ যাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা শনাক্ত করতে না পারেন, সে জন্য খুনিরা এমন কাজ করেছিলেন। গতকাল শনিবার চট্টগ্রাম নগরের কর্ণফুলী সেতু এলাকায় অভিযান চালিয়ে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত দুই আসামি উচিংথোয়াই মারমা (২৩) ও ক্যাসাই অং চৌধুরীকে (৩৬) গ্রেপ্তার করেন র‍্যাবের সদস্যরা। র‍্যাবের কাছে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে সিবলিকে বীভৎস কায়দায় হত্যার বিবরণ তুলে ধরতে গিয়ে গ্রেপ্তার দুই আসামি এই তথ্য জানান।

আজ রোববার বেলা ১১টায় চট্টগ্রামে র‍্যাব-৭ এর চান্দগাঁও কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‍্যাব চট্টগ্রাম-৭–এর অধিনায়ক মো. মাহবুব আলম।

গ্রেপ্তার উচিংথোয়াই মারমা রাঙামাটি জেলার কাউখালীর কলমপতি গ্রামের মংহ্লাজাই মারমার ছেলে এবং ক্যাসাই অং চৌধুরী বান্দরবানের রুমার আশ্রমপাড়ার বাসিন্দা। এ নিয়ে সিবলি হত্যায় জড়িত আট আসামিকে গ্রেপ্তার করলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এর মধ্যে প্রধান আসামি উমংসিং মারমাকে (২৬) সিবলির লাশ উদ্ধারের দিন, গত ১১ সেপ্টেম্বর পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে হত্যা করেন স্থানীয় লোকজন।

পুলিশের অভিযানে সিবলি সাদিকের দেহাবশেষ উদ্ধারের খবর পেয়ে মা নাহিদা আকতারের আহাজারি
ফাইল ছবি

গতকাল গ্রেপ্তার দুই আসামি র‍্যাবের কাছে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে বলেন, খামারের ছয় থেকে সাতজন সহকর্মীকে মুরগির খাদ্য (ফিড) বাইরে বিক্রি করতে বাধা দিয়েছিলেন সিবলি। তখন সিবলির সঙ্গে তাঁদের ঝগড়া হয়। আর তার জেরেই এমন হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে স্বীকার করেছেন তাঁরা। সিবলিকে প্রথমে ছুরি দিয়ে গলা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন উচিংথোয়াইং মারমা নামের একজন। আর হাত–পা চেপে ধরেন উমংচিং মারমা, ক্যাসাইং চৌধুরী মারমাসহ চার থেকে পাঁচজন।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে র‍্যাব–৭–এর অধিনায়ক মো. মাহবুব আলম বলেন, লাশ যেন পুলিশ শনাক্ত করতে না পারে, আসামিরা সেই চেষ্টা করেছেন।

গ্রেপ্তার দুই আসামি র‍্যাবকে আরও জানায়, গণপিটুনিতে নিহত আসামি উমংসিং মারমাই গত ২৮ আগস্ট  সিবলিকে অপহরণের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনিই ফোন করে সিবলিকে রাস্তায় আসতে বলেন।

তখন তিনি খামার থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এলে আসামিরা জোর করে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় তুলে নেন তাঁকে। এ সময় সিবলি চিৎকার করলে মুখে গামছা বেঁধে দেওয়া হয়। তাঁকে অপহরণের পর উমংসিং মারমার মুঠোফোন থেকে সিবলির বাবাকে কল করা হয়। অপহৃত সিবলিকে দিয়ে তাঁর বাবার কাছে ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। মুক্তিপণের টাকা নিয়ে দর-কষাকষির একপর্যায়ে অপহরণকারীরা দুই লাখ টাকার বিনিময়ে অপহৃত ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে রাজি হন। তবে অপহরণের পরদিন ২৯ আগস্ট হত্যা করা হয় সিবলিকে। এরপরও ১ সেপ্টেম্বর বান্দরবানে সিবলির বাবা ও নানার কাছ থেকে মুক্তিপণের দুই লাখ টাকা নেন খুনিরা।

এর আগে এই হত্যায় মামলায় গ্রেপ্তার তিন আসামি আদালতে স্বীকারোক্তি দেন। এর মধ্যে গত ১২ সেপ্টেম্বর সুইচিংমং মারমা (২৪) ও রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার অংথুইমং মারমা (২৫) এবং  ১৪ সেপ্টেম্বর অং ফ্রাই সিং মারমা (৪৬) আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছিলেন।

জবানবন্দিতে তাঁরা বলেছিলেন, খামারের কাজ নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সিবলির সঙ্গে পাঁচ-সাতজন শ্রমিকের বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। এর পর থেকে সিবলির ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন ওই শ্রমিকেরা। তবে এ ঝগড়ার মীমাংসা করে দিয়েছিলেন খামারের মালিকেরা। কিন্তু ভেতরে-ভেতরে এর ক্ষোভ রয়ে গিয়েছিল শ্রমিকদের মধ্যে। তাঁরা পরিকল্পনা করতে থাকেন, সিবলিকে শায়েস্তা করবেন।

অপহরণের পর নির্মম হত্যাকাণ্ডের স্বীকার সিবলি সাদিক রাউজান উপজেলার কদলপুর ইউনিয়নের পঞ্চপাড়া গ্রামের মুহাম্মদ শফির ছেলে। তিনি কদলপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজে একাদশ শ্রেণির দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন। পিকআপ ভ্যানচালক শফির দুই ছেলের মধ্যে বড় তিনি। লেখাপড়ার পাশাপাশি বাড়ির ২০০ মিটার দূরে একটি মুরগি খামারে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে চাকরি করতেন। খামারটিতে ১০ হাজার মুরগি আছে। এটি মূলত ডিমের খামার।

খামারটির মালিক স্থানীয় কদলপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন আহমেদ, ইউপি সদস্য সাহাবুদ্দিনসহ মোট চারজন।

চট্টগ্রাম-৭–এর অধিনায়ক মো. মাহবুব আলম বলেন, চাঞ্চল্যকর এই হত্যা ও অপহরণ মামলায় মোট ৯ থেকে ১০ জন জড়িত। এর মধ্যে দুজনকে র‍্যাব ও বাকি ছয়জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। একজন গণপিটুনিতে মারা গেছেন। অন্য আসামিদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।