শ্রমিক বিক্ষোভ, কারখানা, পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর

ন্যায্য মজুরির দাবিতে গাজীপুরে চলছে পোশাকশ্রমিকদের বিক্ষোভ। বুধবার গুলিতে নিহত হন পোশাকশ্রমিক আঞ্জুয়ারা খাতুন। গতকাল চলে শ্রমিক–পুলিশ পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, সংঘর্ষ। এমন পরিস্থিতিতে কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হলে ভয় ও আতঙ্ক নিয়ে দৌড়ে বের হচ্ছেন এক পোশাককর্মী। বিকেল সাড়ে চারটায় কোনাবাড়ীর তুষুকা গার্মেন্টস লিমিটেডের সামনে
ছবি: সাজিদ হোসেন

ন্যূনতম মজুরি প্রত্যাখ্যান করে গাজীপুরের তিনটি এলাকায় গতকাল বৃহস্পতিবারও বিক্ষোভ করেছেন শ্রমিকেরা। এ সময় পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায় আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন শ্রমিক। ভাঙচুর করা হয়েছে একটি পোশাক কারখানা ও পুলিশের তিনটি গাড়ি। এসব ঘটনায় আটক করা হয়েছে ২৭ জনকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ২২টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়।

এদিকে ঢাকার সাভারের আশুলিয়ার বেশ কয়েকটি কারখানার শ্রমিকেরাও গতকাল বিক্ষোভ করেছেন।

এর আগে ন্যূনতম মজুরি প্রত্যাখ্যান করে গত বুধবার গাজীপুরে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকেরা। এ সময় নগরের পাঁচটি এলাকায় পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সেদিন আহত হয়ে এক নারী পোশাকশ্রমিক নিহত হন।

কাজ বন্ধ করে বিক্ষোভ

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গাজীপুর নগরের চান্দনা এলাকায় গতকাল সকাল ৯টার দিকে একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা কাজ বন্ধ রেখে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে শিল্প ও থানা-পুলিশ তাঁদের বুঝিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এর কিছু সময় পর নাওজোড় এলাকায় শ্রমিকেরা ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। তাঁরা মহাসড়কে টায়ার ও কাঠের গুঁড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন। একপর্যায়ে শ্রমিক ও পুলিশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।

কারখানা ও পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর

স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, দুপুরের পর কোনাবাড়ী বিসিক এলাকায় বিক্ষোভ শুরু করেন শ্রমিকেরা। এ সময় পুলিশ শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে উত্তেজিত শ্রমিকেরা কোনাবাড়ী এলাকার তুষুকা কারখানায় ঢুকে ব্যাপক ভাঙচুর করেন।

ভাঙচুর করা হয় কারখানার যন্ত্রপাতিসহ মূল্যবান মালামাল। এ সময় কারখানার বাইরে রাস্তায় রাখা পুলিশের তিনটি গাড়িও ভাঙচুর করেন শ্রমিকেরা। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনায় ১৫ শ্রমিক আহত হন। তাঁরা স্থানীয় বিভিন্ন ক্লিনিকে চিকিৎসা নিয়েছেন। বিকেল পাঁচটার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।

তুষুকা কারখানার শ্রমিক হাবিবুর রহমান বলেন, তাঁদের কয়েকজন শ্রমিককে পুলিশ মারধর করে। এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে কারখানায় ভাঙচুর চালানো হয়।

তুষুকা গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক মাসুম হোসেন বলেন, শ্রমিকেরা কাজ করছিলেন। হঠাৎ পাশের একটি ভবন থেকে হইহুল্লোড় শোনা যায়। এরপরই বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। একপর্যায়ে শুরু হয়ে যায় ভাঙচুর। তিনি বলেন, কিছু বহিরাগত ব্যক্তি কারখানায় ঢুকেছিলেন। তাঁদের কারখানার শ্রমিকেরা এমন ভাঙচুর করতে পারেন বলে তাঁর মনে হয় না। তাঁদের সন্দেহ বাইরে থেকে আসা লোকজন ভাঙচুর চালিয়েছেন।

শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে গতকাল গাজীপুরের বেশ কিছু কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইমরান আহম্মেদ বলেন, শ্রমিক অসন্তোষের কারণে গাজীপুরের চান্দনা, নাওজোড়, কোনাবাড়ী, জরুনসহ আশপাশের এলাকার ২২টি পোশাক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

কোনাবাড়ী এলাকায় বিজিবির সঙ্গে ছিলেন গাজীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মুরাদ আলী। তিনি বলেন, দুপুরের পর শ্রমিকদের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপরই শ্রমিকেরা রাস্তায় নেমে আসেন ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটান। পরে তাঁরা শ্রমিকদের বোঝাতে সক্ষম হন। বিকেল পাঁচটার পর থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।

‘কুচক্রী মহল পরিস্থিতি খারাপ করার চেষ্টা করছে’

বিকেল পাঁচটার দিকে কোনাবাড়ী এলাকায় র‌্যাব-১–এর পক্ষ থেকে ব্রিফ করা হয়। সেখানে ২৭ জনকে আটকের কথা জানানো হয়।

র‌্যাব-১–এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মুহাম্মদ মোসতাক আহমদ বলেন, কিছু কুচক্রী মহল শ্রমিকদের সঙ্গে মিশে পরিস্থিতি খারাপ করার চেষ্টা করছে। এই বিক্ষোভের সঙ্গে বিএনপি ও বিরোধী দলের সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, এর সঙ্গে কুচক্রী মহল জড়িত। এটাতে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।’

মোসতাক আহমদ জানান, কোনাবাড়ী এলাকা থেকে ২৭ জনকে আটক করা হয়েছে। যাচাই–বাছাই করে তাঁদের ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

আশুলিয়ায়ও বিক্ষোভ

গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঢাকার সাভারের আশুলিয়ার জামগড়া, নরসিংহপুর, নিশ্চিন্তপুর, কাঠগড়া এলাকার বেশ কয়েকটি কারখানার শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করেছেন।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, নরসিংহপুর এলাকায় পুলিশকে লক্ষ্য করে শ্রমিকেরা ইটপাটকেল ছোড়েন। এতে শিল্প পুলিশ-১–এর সহকারী পুলিশ সুপার এ বি এম রশিদুল বারী আহত হন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে শ্রমিকেরা নরসিংহপুর এলাকায় একটি কাভার্ড ভ্যান ভাঙচুর করেন। এ সময় শ্রমিকদের ছোড়া ইটপাটকেলে গাড়ির চালক নাছির আহত হন। জামগড়া ও নরসিংহপুরে পুলিশ ধাওয়া দিয়ে ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

বেলা দেড়টার দিকে নরসিংহপুর এলাকায় পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় স্থানীয় সাংবাদিক এম আতিককে মারধরে করে তাঁর ক্যামেরা ও মুঠোফোন নিয়ে যান শ্রমিকেরা। সন্ধ্যায় কয়েকজন শ্রমিক ক্যামেরা ও মুঠোফোন ফেরত দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন।

ঢাকা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) শাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সকালের দিকে শ্রমিকেরা কিছু সময়ের জন্য সড়কে জড়ো হলে তাঁদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। দুপুরের পর থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।