ঘূর্ণির জাদুতে বিশ্বজয় 

নাঈম হাসান

শ্রীলঙ্কার মাঠে সেদিন দুপুরটা ছিল অস্বস্তিকর গরমের। এর সঙ্গে যোগ হলো ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে থাকা দুই লঙ্কান ব্যাটারের তাণ্ডব। দুজনের ভাবভঙ্গিতে যেন ফুটে উঠল না–বলা কথা—‘আমরা থামব না।’ দ্রুত বাউন্ডারি আসছিল, রানের চাকা ঘুরছিল। হতাশায় ডুবে যাচ্ছিলেন বাংলাদেশ দলের বোলাররা।

এরপর হঠাৎ এক তরুণ অফ স্পিনার এসে খেলার রংটাই পাল্টে দিলেন। তুলে নিলেন দিনেশ চান্ডিমালের উইকেট। ঘুরে গেল খেলার মোড়। দেড় শ রানের অটল জুটি ভেঙে দিয়ে খেলার গল্প বদলে দেন যে ছেলেটি—তিনি নাঈম হাসান।

শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে পাঁচ উইকেট নিয়ে নাঈম যেন মাঠে এক ‘ঘূর্ণিঝড়’ বইয়ে দেন। বাংলাদেশের দল হঠাৎ পায় নতুন প্রাণ, নতুন ছন্দ। সেই ম্যাচ ড্র হয়; কিন্তু নাঈমের বোলিংয়ের জাদু থেকে যায় গ্যালারির গুঞ্জনে, ভক্তদের আলোচনায়। এ বছরের জুনে শ্রীলঙ্কার গলে টেস্ট ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন নাঈম। ওই ম্যাচের প্রথম ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ওভার বল করেন তিনি। দেন সবচেয়ে কম রান। 

চট্টগ্রামের আলো–বাতাস গায়ে মেখে বড় হওয়া ছেলে নাঈম। পাড়ার মাঠ থেকে উঠে এসে আপন আলোয় জ্বলে ওঠা অদম্য স্পিনার। স্পটলাইট থেকে দূরে দাঁড়িয়ে নিজের খেলাটাকে নিখুঁত করে তুলতে যাঁরা চেষ্টা করেন—নাঈম তাঁদের একজন। দলে থাকেন, পারফর্ম করেন, আবার নিঃশব্দে সরে যান। আলোচনার কেন্দ্রে তিনি থাকেন না, কিন্তু তাঁর বোলিংয়ের ঘূর্ণি মাঠের বাইরের সব আলো নিজের দিকে টেনে নেয়।

শুরুটা সেই গলির মাঠে

নাঈমের ক্রিকেটে হাতেখড়ি কৈশোরে। টেপ টেনিসের উচ্ছ্বাস, গলির ক্রিকেটের পাগলামি; যেখানেই ব্যাট-বল, সেখানেই ছুটে যাওয়া। খেলাপাগল ছেলেটির ব্যাটে জোর ছিল, বোলিংয়েও তেমন দাপুটে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাট থেকে বলের দিকেই বেশি ঝুঁকে গেলেন তিনি।

পাহাড়-সাগর-হ্রদে ঘেরা বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ফরিদারপাড়া এলাকা। নাঈমের ছোটবেলার পথচলা শুরু হয়েছিল এই এলাকাতেই। তাঁদের বাড়িটি একসময় লোকের কাছে ‘মাহবুব কাউন্সিলরের’ বাড়ি হিসেবে পরিচিত ছিল। সময়ের স্রোতে সেই নাম পাল্টে গেছে। এখন মানুষ চেনে ক্রিকেটার ‘নাঈম হাসানের বাড়ি’ হিসেবে।

জাতীয় দলের খেলা হলে ফরিদারপাড়ার মানুষ বসে যান টিভির সামনে। যখন নাঈম বল হাতে এগিয়ে আসেন, এলাকাবাসীর উচ্ছ্বাস–উত্তেজনা বেড়ে যায়। দরজা-জানালার ফাঁক দিয়ে শুনতে পাওয়া যায় সম্মিলিত ফিসফাস—‘উইকেট চাই নাঈম, উইকেট চাই’।  নাঈমের ছোট সাফল্য-ব্যর্থতাতেও মানুষের অনুভূতির ছায়া লেগে থাকে এ এলাকায়।

সমুদ্রপাড়ে লেখা ইতিহাস

২০১৮ সালের ২২ নভেম্বর। চট্টগ্রামের সমুদ্রঘেঁষা সাগরিকা স্টেডিয়ামের সকালটা যেন একটু উজ্জ্বল ছিল সেদিন। নাঈমের চোখে আলো, মনে উত্তেজনা। হয়তো তার চেয়েও বেশি ছিল একধরনের নীরবতা, যেটা বড় দিনে বড় খেলোয়াড়ের মনেই জন্ম নেয়। জাতীয় টেস্ট দলের জার্সিটি প্রথমবার তাঁর গায়ে ওঠে সেদিন। তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর ২৮৩ দিন। শুরুর দিনেই তিনি ইতিহাস লিখে ফেললেন। প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজের পাঁচ উইকেট তুলে নিয়ে টেস্ট অভিষেকেই রেকর্ড গড়েন চট্টগ্রামের এই সন্তান। মাঠে তখন উৎসব।

স্টেডিয়াম পেরিয়ে উৎসব শুরু হয় ফরিদারপাড়ার বাড়িতেও। নাঈমের মা মমতাজ বেগম পরে বলেছিলেন, ‘চোখে পানি এসে গিয়েছিল। গর্বে, আনন্দে, বিস্ময়ে।’ টিভিতে  তাঁর ছেলেকে বল করতে দেখে নীরবে বলেছিলেন, ‘আমার ছেলেটা জাতীয় দলে খেলছে।’

হঠাৎ এক তরুণ অফ স্পিনার এসে খেলার রংটাই পাল্টে দিলেন। তুলে নিলেন দিনেশ চান্ডিমালের উইকেট। ঘুরে গেল খেলার মোড়।

সাগরিকা স্টেডিয়াম সেই থেকে নাঈমের কাছে শুধু একটা মাঠ নয়, এটাই তাঁর আত্মবিশ্বাসের ঘর। এখানে পাঁচ উইকেটের পর অন্য ম্যাচে ৬ উইকেটও নিয়েছেন। এই মাঠেই তিনি খুঁজে পেয়েছেন নিজের ছন্দ, নিজের সত্তা।

তবু আফসোস

নাঈমের ক্যারিয়ারের দিকে তাকালে একধরনের বৈপরীত্য চোখে পড়ে। সাত বছরে তিনি খেলেছেন মাত্র ১৪ টেস্ট। এর মধ্যে চারবার নিয়েছেন পাঁচ উইকেট। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা ছবি। ৬৯ ম্যাচে ২৭৬ উইকেট। ১৮ বার ৫ উইকেট ও ৩ বার নিয়েছেন ১০ উইকেট।

বিপিএলে নাঈমের নামের পাশে আছে ৩০ উইকেট। চিটাগং ভাইকিংস, কুমিল্লা ভিকটোরিয়ানস, ফরচুন বরিশাল, সিলেট থান্ডার্স—এসব দলে খেলে তিনি হয়ে উঠেছেন পরের প্রজন্মের অফস্পিনের প্রতিশ্রুতি।

প্রতিটি ম্যাচেই দেখা যায়—নাঈম নিজের খেলা নিয়ে কতটা মনোযোগী। তিনি নিজের স্পেল নিয়ে ভাবেন, চক্র ভেঙে কীভাবে ব্যাটসম্যানকে ভুল করানো যায়, তা নিয়েই থাকেন।

যে স্পিনার এতটা ধারাবাহিক, তাঁকে আরও বেশি সুযোগ না দেওয়ার আক্ষেপ থেকেই যায়। নাঈমের বাবা মাহবুবুল আলমের চোখের কোণে সেই আক্ষেপ জমে আছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নাঈমকে নিয়ে আমাদের গর্ব আছে। কিন্তু সে সুযোগ পায় কম। আরও সুযোগ পেলে নামের পাশে উইকেটের সংখ্যা ভিন্ন হতো।’

নাঈম হাসান

অশ্বিনের সঙ্গে এক দিন

নাঈম কৌতূহলী। শেখার জন্য পুরো মন-মগজ ঢেলে দেন। বিশ্বের সেরা বোলারের বোলিং তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। তাঁদের অ্যাকশন, স্পিড, আর্ম অ্যাঙ্গেল—সব বিশ্লেষণ করেন। সে জন্যই ভারত সফরে যখন রবিচন্দ্রন অশ্বিনের সঙ্গে দেখা হয়, তখন সেটা তাঁর জন্য ‘মাস্টারক্লাস’ হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্ব ক্রিকেটের সেরা অফ স্পিনারদের একজন অশ্বিন। তাঁর নামে পাশে আছে ৫৩৭ টেস্ট উইকেট।

গত বছরের অক্টোবরের এক প্রহরে অশ্বিনের মুখোমুখি হন নাঈম। যাওয়ার আগে অশ্বিনের বোলিংয়ের শৈলী ধরে ধরে বিশ্লেষণ করে গিয়েছিলেন। তাই মুখোমুখি আলাপে তিনি শুধু ছাত্র নন, ছিলেন একজন প্রস্তুত তরুণ, যিনি সত্যিই শিখতে চান।

সেই কথোপকথন ছিল কৌশলের, মাঠের মনস্তত্ত্বের, ব্যাটসম্যানের আচরণের। কখন টপ স্পিন করতে হবে, কখন সাইড স্পিনের দরকার; এসব টোটকা পেয়েছিলেন অশ্বিনের কাছ থেকে। অশ্বিন বলেছিলেন, কন্ডিশন বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এটাই স্পিনারের আসল শক্তি।

ফিল্ড সেটিং নিয়েও গভীর আলোচনা হয়। অশ্বিন উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, ‘মুশফিক সুইপ ভালো খেলে, তাই আমি বাউন্ডারিতে ফিল্ডার রেখে দেব। যাতে সে সুইপ করে চার না পায়, রান কমে যায়। চাপ তৈরি হয়। তখন তাঁর ভুল শটের সুযোগ বাড়ে।’ এই কথা নাঈম পরে প্রয়োগ করেছেন মাঠে। আর এই আলাপ তাঁর ক্রিকেটীয় মানসিকতায় পরিবর্তনও এনে দিয়েছে।

যাঁর হাত ধরে রূপান্তর

নাঈমের ক্রিকেটের পথচলা শুরু হয়েছিল ব্রাদার্স ক্রিকেট একাডেমিতে। কোচ মমিনুল হকের চোখের সামনেই নাঈমের প্রথম রূপান্তর ঘটে। প্রথম দিকে নাঈম ছিলেন পেস বোলার। তরুণ বয়সের উচ্ছ্বাসে তিনি বলটি কেবল ছুড়ে ফেলতেন দ্রুতগতিতে। কিন্তু কোচ খুঁজে পেলেন অন্য কিছু। স্লো আর্ম আর কবজির সম্ভাবনা।

মমিনুল হক বলেছিলেন, ‘স্পিন করো। তোমার হাত, আর্ম, ফিঙ্গার; এসবের জন্য স্পিনই ভালো।’ এই পরামর্শে বদলে যায় সব। কোচ বলেন, নাঈম খুবই মনোযোগী। একাগ্রভাবে কাজ করতে চায়। শৃঙ্খলা আর একাগ্রতা—এই দুইয়েই তৈরি হয়েছে আজকের নাঈম।

নাঈম যতটা প্রতিভাবান, ততটাই নীরব যোদ্ধা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিনি ইনজুরি দেখেছেন, বাদ পড়েছেন, আবার ফিরে এসেছেন। ফিরে এসে নিজের জায়গাটা দখল করেছেন কঠোর পরিশ্রমে।

নাঈমের চোখে একটা অদৃশ্য দৃঢ়তা। মাঠে যখন তাঁকে দেখা যায়, তখন অনুভব করা যায়—এই ছেলেটা শুধু খেলতে চায় না, নিজের গল্পও লিখতে চায়। নিজের ব্যাট ও বলে ভবিষ্যৎ আঁকতে থাকে নিঃশব্দে। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে তিনি শুধু বলেছিলেন, পরিশ্রম করে যাচ্ছি।

একঝলক আলো

নাঈম এখনো তরুণ। তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বেশ বড়। দীর্ঘ সময় বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের হয়ে লড়তে চান। টেস্টে তাঁর সুযোগ সীমিত হলেও প্রতিবার মাঠে নামলে তিনি নিজের মূল্য দেখিয়ে দেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটের চাওয়া-পাওয়া, সুযোগ-সংকট; সব মিলিয়ে নাঈম যেন সাগরের কাছে জন্ম নেওয়া এক ঘূর্ণি, সঠিক বাতাস পেলে ভয়ংকর হবেন। চট্টগ্রামের গলি থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আলোয় তিনি উঠে এসেছেন। এটা কেবল খেলার নয়, মানুষের ইচ্ছাশক্তির গল্প।