মিয়ানমার সীমান্তে তীব্র লড়াই, পালিয়ে এলেন ৬৮ সীমান্তরক্ষী

আরাকান আর্মির হামলার মুখে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) সদস্যরা পালিয়ে বাংলাদেশের ঘুমধুম সীমান্ত ফাঁড়ির ভবনের পাশে আশ্রয় নেন
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় কয়েক দিন ধরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর লড়াইয়ের তীব্রতা বেড়েছে। লড়াইয়ের মধ্যে গতকাল রোববার মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) ৬৮ সদস্য বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁদের নিরস্ত্র করে হেফাজতে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিজিবি।

স্থানীয় লোকজন জানান, মিয়ানমারে দুই পক্ষের লড়াইয়ের সময় মর্টার শেল ও গুলি এসে পড়ছে এখানকার গ্রামগুলোতে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু ও ঘুমধুমের কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারা আতঙ্কে এলাকা ছেড়েছেন। সর্বশেষ গতকাল সকালে সীমান্তের ওপার থেকে ছোড়া গুলিতে নাইক্ষ্যংছড়ির তিন বাংলাদেশি আহত হন। এর আগের রাতে মর্টার শেল পড়ে এক বাংলাদেশির ঘরে আগুন ধরে যায়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সাতটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একটি সড়কে যানবাহন চলাচলও সীমিত করা হয়েছে।

মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৮৩ কিলোমিটার। এর বড় অংশ পড়েছে বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায়। কয়েক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত–সংলগ্ন এলাকায় যুদ্ধ জোরালো করেছে আরাকান আর্মিসহ কয়েকটি গোষ্ঠী। তারা সম্মিলিতভাবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। এর মধ্যে কোনো কোনো সীমান্ত শহর দখল করে নিয়েছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা এ সংঘাতের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় সতর্ক অবস্থানের কথা জানিয়েছে কক্সবাজার এবং বান্দরবানের জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তের ওপারে সংঘর্ষ

বান্দরবানের ঘুমধুম সীমান্তের ওপার থেকে আসা গোলায় বাইশফাঁড়ি এলাকার নুরুল কবীরের বাড়িতে আগুন ধরে যায়
ছবি: সংগৃহীত

নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের বাসিন্দারা জানান, গত শনিবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে সীমান্তের ওপারে ব্যাপক গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। সংঘর্ষ একটানা বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত চলে।

গতকাল ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তে সরেজমিনে দেখা যায়, সীমান্তের ৩৪ ও ৩৫ নম্বর পিলারের ওপারে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির দুটি চৌকি রয়েছে। চৌকিগুলো হলো তুমব্রু রাইট ক্যাম্প ও ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি।

সীমান্তের ওপারের পরিস্থিতি সম্পর্কে স্থানীয় লোকজন নানাভাবে খবরাখবর পাচ্ছেন। তাঁরা জানান, ভোরে এই চৌকিগুলোর মধ্যে তুমব্রু রাইট ক্যাম্পে আক্রমণ করে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। এ সময় আরাকান আর্মির সঙ্গে ব্যাপক গোলাগুলি হয়। দুপুর ১২টা ও বেলা ৩টার দিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে সীমান্তের ওপারে গোলাবর্ষণ করে বলে জানা যায়।

নাইক্ষ্যংছড়ির পশ্চিমকুল জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন ফরিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল বিকেল পাঁচটার পর গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাননি।

স্থানীয় সূত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, এর আগে গত ২৯ জানুয়ারি ও ৩১ জানুয়ারি ঘুমধুম সীমান্তের ওপার থেকে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। সে সময় মর্টার শেল ও গোলার অন্তত চারটি অংশ তুমব্রু, কোনারপাড়া ও পশ্চিম ঘুমধুমে এসে পড়ে।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও পুলিশ সূত্র বলছে, সংঘর্ষের মধ্যে গতকাল ভোরে বিজিপির ১৪ জন সদস্য সীমান্তের ওপার থেকে নাইক্ষ্যংছড়িতে পালিয়ে আসেন। এর কয়েক ঘণ্টা পর একই সীমান্ত দিয়ে বিজিপির আরও ৫৪ জন সদস্য পালিয়ে আসেন। বিজিবি তাদের নিরস্ত্রীকরণ করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে আহত ১৫ সদস্যকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

পুলিশের ঘুমধুম তদন্তকেন্দ্রের পরিদর্শক মাহফুজ ইমতিয়াজ ভূঁইয়া গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, নাইক্ষংছড়িতে পালিয়ে আসা আহত কয়েকজন বিজিপি সদস্যকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে আরাকান আর্মির কোনো সদস্য সীমান্তের ওপার থেকে বাংলাদেশে এসেছে, এমন তথ্য তাঁর কাছে নেই।

এপারে আতঙ্ক, বাড়িঘর ছাড়ছেন মানুষ

গুলিতে আহত তুমব্রু সীমান্তের বাসিন্দা প্রবিন্দ্র কুমার ধর। গতকাল সকালে
ছবি: সংগৃহীত।

ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তের ওপারে গোলাগুলি, মর্টার শেল নিক্ষেপ ও হেলিকপ্টার থেকে গোলাবর্ষণের ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে ঘুমধুমের পাঁচটি গ্রামে। এসব গ্রামের মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেন।

সরেজমিনে জানা যায়, সীমান্তবর্তী কোনারপাড়ার ২৩ পরিবার, মধ্যমপাড়ার ২২ পরিবার, উত্তর পাড়ার ১০ পরিবার, হিন্দুপাড়ার ২২ পরিবার ও পশ্চিমকুলের ১০ পরিবার গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে।

তুমব্রু সীমান্তের ৩৪ নম্বর পিলারের কাছাকাছি কোনারপাড়ার অবস্থান। এই গ্রামের তিনজন বাসিন্দা গতকাল দুপুরে জানান, গতকাল ভোরে নারী ও শিশুদের কক্সবাজারের উখিয়ায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। যাঁরা এখনো যাননি, তাঁরা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। একই গ্রামের কুলসুমা বেগম জানান, তাঁর স্বামী প্রবাসে থাকেন। তিন সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বোনের বাড়িতে যাচ্ছেন। তিনি চলে গেলে তাঁর বাড়ি পাহারা দেওয়ার কেউ নেই। বাধ্য হয়ে তিনি গ্রাম ছেড়ে যাচ্ছেন।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য দিল মোহাম্মদ ভুট্টো প্রথম আলোকে বলেন, জেলা প্রশাসনের নির্দেশে মাইকিং করে গ্রামের লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়া হয়েছে।

সীমান্তের ওপার থেকে আসা গুলিতে তিনজন বাংলাদেশি আহত হওয়ার কথা জানিয়েছেন ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ। তিনি বলেন, মিয়ানমারের ওপারে ছোড়া গুলি বাংলাদেশে এসে পড়েছে। এতে প্রবিন্দ্র কুমার ধর, টিটু ও হালিমা নামের তিনজন আহত হয়েছেন। তাঁদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

তুমব্রু সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নুরুল করিম জানিয়েছেন, গত শনিবার রাতে গোলা এসে পড়ায় বাইশফাঁড়ির একটি ঘরে আগুন ধরে যায়। আরও কয়েকটি বাড়িঘরে গুলি এসে পড়েছে।

আরও পড়ুন

সাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ

বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, শনিবার রাত থেকে সীমান্তের ওপারে হঠাৎ গোলাগুলি বেড়ে যায়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তার বিষয়টি চিন্তা করে ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্তের কাছে পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ সাতটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্ত ঘেঁষে যে সড়কগুলো গেছে, সেগুলোতে ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল নিষেধ করা হয়েছে। গণপরিবহন চলাচলও সীমিত করা হয়েছে।

‘ফেরত পাঠানো হবে’

মিয়ানমার থেকে ছোড়া একটি গোলার অংশবিশেষ এসে পড়ে তুমব্রু বাজারে। গতকাল সকালে

রাখাইন রাজ্য (আরাকান) ভিত্তিক বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি হচ্ছে ইউনাইটেড লিগ অব আরাকানের (ইউএলএ) সামরিক শাখা। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে। আরাকান আর্মি ১৩ নভেম্বর রাখাইনে ‘অপারেশন ১০২৭’ শুরু করে। এর পর থেকে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে ব্যাপক লড়াই চলছে। এর আগে অক্টোবরে আরাকান আর্মি সামরিক বাহিনী বিরোধী সশস্ত্র জোট ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের অংশ হিসেবে ব্যাপকতর লড়াইয়ে যোগ দেওয়ার ঘোষণা দেয়।

সর্বশেষ শনিবার মিয়ানমারের আরেক প্রান্তে ভারতঘেঁষা পালেতোয়া শহরের মিওয়া ঘাঁটির শেষ সেনাচৌকিটি দখলে নেয় আরাকান আর্মি। ২০২০ সালে একবার এই ঘাঁটি ৪২ দিনের টানা লড়াইয়ের পর দখল করতে ব্যর্থ হয়েছিল তারা। ইতিমধ্যে এসব এলাকা থেকে কয়েক শ মিয়ানমারের সৈনিক পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে বাংলাদেশে প্রবেশের ঘটনা এবারই প্রথম ঘটল।

সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল সরকারের দুজন মন্ত্রী সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন।

মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ের রেশ বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় পড়ার কারণে চীনের সহায়তা প্রত্যাশা করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গতকাল সচিবালয়ে ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। পরে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, যুদ্ধটা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ। গোলাগুলির আওয়াজ যখন বাংলাদেশে চলে আসে, তখন স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের (সীমান্ত এলাকার) নাগরিকদের মধ্যে ভয়ভীতি ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ বিষয়ে তাদের (চীন) সহায়তা আশা করছেন তিনি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, মিয়ানমারে যে যুদ্ধ চলছে, সেই যুদ্ধ কত দিন চলবে, জানা নেই। সীমান্ত অতিক্রম করে কাউকে আসতে দেওয়া হবে না। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিকে সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির সদস্যরা আত্মরক্ষার্থে বাংলাদেশে ঢুকেছেন। এটা হতেই পারে। তাঁদের (বিজিপির সদস্য) আটক করে রাখা হয়েছে, ফেরত পাঠানো হবে।