রুমাল-মানিব্যাগ বেচে ৪০ বছর ধরে সংসার চালাচ্ছেন রূপসা ঘাটের ইউসুফ

খুলনার রূপসা ঘাটের পূর্ব পাড়ে রুমাল-মানিব্যাগ বিক্রি করে সংসার চালান ইউসুফ মোল্লা
ছবি: প্রথম আলো

খুলনা শহরের অন্যতম প্রবেশদ্বার রূপসা ঘাটের পূর্ব পাড়ের রাস্তার দুই পাশে সারি বাঁধা বাস। টানা চার দিন পর শুক্রবার ঝলমলে রোদে শুরু হওয়া সকালে মানুষের আনাগোনা একটু বেশিই। পরিবহনশ্রমিকেরা হাঁকডাক করে যাত্রী জোগাড় করছেন। বিচিত্র সুর আর নানা ভঙ্গিমায় চলছে তাঁদের ‘এই মোংলা, এই বাগিরহাট’ ডাক।

তাঁদের হাঁকডাক সাময়িক থামতেই কানে ভেসে আসে অন্য সুর—‘এই রুমাল... মানিব্যাগ আছে; ব্রাশ কেনেন, কিনতে পারেন চিরুনি।’ ঘাটের গ্যাংওয়ের মাথায় দাঁড়িয়ে মাঝবয়সী একজন এসব বিক্রি করছিলেন। সাতসকালেই তাঁর বেচাবিক্রি একবারে কম না। ক্রেতাকে জিনিস বুঝিয়ে দিতে দিতেও তিনি হেঁকে চলছিলেন।

বেশ কিছুক্ষণ তা দেখার পর কাছে যেতেই মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে নিজে নিজেই বললেন, ‘মানুষ তো ব্যস্ত, অনেক সময় খেয়াল থাকে না।’ মানুষটার নাম ইউসুফ মোল্লা। বয়স ৫৫ বছর। বাড়ি রূপসা উপজেলার ঘাটভোগ গ্রামে। ইউসুফের বাবা হাটে হাটে নৌকায় করে মালামাল পরিবহনের কাজ করতেন। বয়স যখন তিন-চার বছর তখন ইউসুফের বাবা মারা যান। ১৩-১৪ বছর বয়স থেকেই ইউসুফ এ ব্যবসা করছেন।

ইউসুফ বলেন, বাবার স্মৃতি মনে নেই। বাবার মাত্র দু-চার কাঠা জমি ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর মা পরের বাসায় কাজ শুরু করেন। তখন অবশ্য এলাকায় অনেকে এ ব্যবসা করতেন। দেখাদেখি মা ডালা-ঝুড়িতে করে গ্রামে গ্রামে এসব জিনিস বিক্রি করতেন। ইউসুফ এ কাজে আছেন ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে।

রুমাল, ম্যানিবাগ, বিভিন্ন পদের চিরুনি, মাস্ক, ব্রাশ, সেফটিফিন, কটন বাড, সাবান মাখার মাজুনি, নখ কাটার যন্ত্রসহ বিভিন্ন আইটেম মেলে ইউসুফের কাছে। কাঠের তৈরি স্ট্যান্ডের গায়ে ঝোলানো থাকে মালামাল। প্রতিদিনের মালামাল প্রতিদিন কেনেন। সাইকেলে করে সাড়ে ছয়টার মধ্যে ঘাটে আসেন। একটানা দাঁড়িয়ে বিক্রির মধ্যেই বেলা ১১টার দিকে হোটেলে কিছু খেয়ে নেন। বেলা তিনটার দিকে বেচাকেনার পাঠ চুকিয়ে যান বাড়িতে।

খুলনা বাগেরহাট অঞ্চলে যোগাযোগব্যবস্থার অনেক বদল ঘটেছে। রূপসা থেকে বাগেরহাটে রেলপথ বন্ধ হয়েছে। বন্ধ হয়েছে রূপসা ফেরি। আবার রূপসা নদীতে সেতু হয়েছে। এ সবকিছু ঘটেছে ইউসুফের একবারে চোখের সামনে।

ইউসুফ জানান, রূপসা সেতু চালু হওয়ার পর ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে গেলেও রূপসা পাড়ের খেয়াঘাট আজও ‘রূপসা ফেরিঘাট’ নামেই পরিচিত। ট্রলারের মাধ্যমে প্রতিদিন কম করে ৪০ হাজার মানুষ পারাপার হয় এ ঘাট দিয়ে।

রূপসা-বাগেরহাট রেলপথে হকারিজীবন শুরু করেছিলেন ইউসুফ
ছবি: প্রথম আলো

স্মৃতিচারণা করে ইউসুফ বলেন, রূপসা-বাগেরহাটে যে রেল চলাচল করত, সেই রেলে হকারিজীবন শুরু। এরপর কিছুদিন খুলনা রেলস্টেশনে আর বিভিন্ন হাটে-ঘাটে যেতেন। তবে এ ঘাট এলাকাতেই কেটেছে জীবনের বেশির ভাগ সময়। রূপসা ফেরিতে হকারি করতেন। এরপর ফেরিও বন্ধ হলো। এর পর থেকে ঘাটে দাঁড়িয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন।

তবে ইউসুফ ঘাটের বিক্রি করার বাইরে মাঝেমধ্যে বড় বড় মেলায় যান। ইউসুফ বলেন, ‘আগে পাঁচ-সাতজনের গ্রুপ করে প্রায় সব মেলাতেই যেতাম। এখন দু-তিনজন মিলে শুধু বড় মেলাতে যাই। মেলায় অল্প সময়ে অনেক লাভ হয়।’ ফরিদপুরের বোয়ালমারীর কাটাগড় মেলা, মাদারীপুরের গণেশ পাগলের মেলা, গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দি মেলাসহ বিভিন্ন বড় মেলায় যান তাঁরা।

রোজগার কেমন, জানতে চাইলে ইউসুফের উত্তর, রোজগারের চেয়ে বড় কথা কাজে স্বাধীনতা আছে। ইচ্ছা হলো করলেন, মন না চাইলে করলেন না। আর রোজগার বেচাকেনার ওপর নির্ভর করে। বেচাবিক্রি যত বেশি, লাভ তত বেশি। এখন ‘অফসিজন’। এরপরও এখন দিনে শ চারেকের মতো থাকছে। ‘সিজনে’ বেশি বিক্রি হয়।
‘সিজনের’ (মৌসুম) ব্যাখ্যা দিয়ে ইউসুফ বলেন, সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় রুমাল। গরম পড়লে রুমাল বেশি চলে। আবার দুই ঈদ আর পূজায় চাপ বাড়ে। তখন দিনে ৭০০-৮০০ টাকা লাভ থাকে।

হকারেরা পেশা বদল করছেন জানিয়ে ইউসুফ বলেন, ‘আগে বেচাবিক্রি বেশি হতো। সব জায়গায় জিনিসপত্র পাওয়া যেত না। এখন ব্যবসা কমে গেছে। প্রতিটি গ্রামে মোড়ে মোড়ে দোকান হয়ে গেছে। আগে ঘাটে অনেকেই এ কাজ করতাম। এখন হকার কমে গেছে। আগের মতো ব্যবসা নেই।’

স্বামী-স্ত্রী আর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে ইউসুফের সংসার। দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে ছেলে আর পড়তে চায়নি। ছেলেকে এ ব্যবসায় ঢুকিয়েছেন। সব মিলিয়ে ভালো আছেন জানিয়ে ইউসুফ বলেন, লোক কম, সংসার ভালো চলছে। ব্যবসার টাকায় বাজারসদাই করে যা থাকে, তা থেকে কিছু জমান আর মালামাল কেনেন। বাড়িতে পাকা ঘর করেছেন। তবে বাজারে এখন সব জিনিসের দাম অনেক বেশি। টাকা জমানো যাচ্ছে না।