‘মরা খালে’র বালুচরে সবুজের সমারোহ

শীত মৌসুমে ছোট যমুনা নদীতে পানির প্রবাহ কমে গেছে। নওগাঁর আত্রাই উপজেলার জাতোপাড়া এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

নওগাঁর প্রধান দুই নদী আত্রাই, ছোট যমুনাসহ সাতটি নদী যেন মরা খাল। বর্ষায় নদ-নদীতে কিছুটা পানির দেখা মিললেও শুকনা মৌসুমে সরু খালে পরিণত হয়। পানি না থাকায় নদ-নদীর বুকে জেগেছে বালুচর। এখন সেখানে চলছে নানা ফসলের আবাদ।

সম্প্রতি নওগাঁর আত্রাই, রানীনগর, মান্দা ও বদলগাছী উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, আত্রাই ও ছোট যমুনা নদীতে সরু খালের মতো পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এর দুই ধারে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভেতরে নদীর বুকে একরের পর একর চর জেগে উঠেছে। এসব চরে আবাদ হয়েছে ভুট্টা, গম, বাদাম, আলু, মরিচ, মিষ্টি আলু, মিষ্টিকুমড়াসহ বিভিন্ন শাকসবজি। ফসলের খেতে কাজে ব্যস্ত কৃষকেরা।

আত্রাই ও ছোট যমুনা ছাড়াও অন্য নদীগুলোরও একই অবস্থা। আত্রাইতে পানি না থাকায় এর শাখা নদী ফকিরনী ও শিবও শুকিয়ে গেছে। এ ছাড়া আন্তসীমান্ত নদী পুনর্ভবার উৎসমুখে ভারত বাঁধ দেওয়ায় পানিপ্রবাহ একেবারেই নেই। নাগর ও তুলশীগঙ্গা নদীরও একই অবস্থা। এসব নদীর বুকেও জেগে উঠেছে বিস্তীর্ণ চর। এসব চরে আবাদ হচ্ছে বিভিন্ন রবি ফসল।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দু-তিন দশক আগেও অবস্থা এ রকম ছিল না। মাঠের পর মাঠ পড়ে থাকত ধু ধু বালুচর। কিন্তু এসব চরে এখন নানা রকমের ফসল চাষাবাদ করে লাভবান স্থানীয় কৃষকেরা। দিন যতই যাচ্ছে নদীর বুকে ফসল আবাদের পরিমাণ ততই বাড়ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রমতে, আত্রাই বাংলাদেশ-ভারতের আন্তসীমান্ত নদী। এটির উৎপত্তি পশ্চিমবঙ্গে। ভারতের বালুরঘাট ব্লকের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার শিমুলতলী সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। নদীটি ধামইরহাট, পত্নীতলা, মহাদেবপুর, মান্দা ও আত্রাই উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলনবিলে গিয়ে মিলিত হয়েছে।

ছোট যমুনা নদীর উৎপত্তি দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার একটি উন্মুক্ত বিলাঞ্চল থেকে। নদীটি দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার চৌঘরিয়া সীমান্ত দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে পুনরায় জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলায় ঢুকেছে। এটি নওগাঁর বদলগাছী, নওগাঁ সদর ও রানীনগর উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নওগাঁর আত্রাই উপজেলায় আত্রাই নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।

প্রতিবছর বর্ষায় ভারত ওপার থেকে পানি ছেড়ে দেয়। উজান থেকে নেমে আসা পানির তোড়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে নওগাঁর বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। উৎসমুখে ভারত জলকপাট ও বাঁধ নির্মাণ করায় শুকনা মৌসুমে আত্রাই ও ছোট যমুনা নদীতে প্রবাহ একেবারেই কমে যায়। তখন নদীর বুকে জেগে ওঠে বালুচর।

আত্রাই নদীর চরে চাষ করা হয়েছে আলু। সম্প্রতি নওগাঁ মান্দা উপজেলার চকরামপুর এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

গত রোববার আত্রাই উপজেলার রাইপুর, জাতোপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ছোট যমুনা নদীর বুকে জেগে ওঠা চরে ভুট্টা, গম, আলুসহ বিভিন্ন রবি ফসল আবাদ করা হয়েছে। সেখানে ভুট্টার চাষ করেছেন রাইপুর গ্রামের বাসিন্দা শ্রীলাল বর্মণ। তিনি বলেন, ‘হামরা গরিব মানুষ। আবাদ করার মতো জমিজমা নাই। শুকনা মৌসুমত নদীত চর জ্যাগলে সেটি অ্যানা ভুট্টা, গম আবাদ করি। চার-পাঁচ বছর ধরে হামি চরত আবাদ করোছি। আরও অনেকেই আবাদ করে।’

রাইপুর গ্রামের কৃষক পিয়ার আলী ও আবেদ আলী বলেন, কয়েক বছর ধরেই তাঁদের এলাকায় ছোট যমুনা নদীর বুকে জেগে ওঠা চরে চাষাবাদ হচ্ছে। নদীর চরে আবাদ করায় খরচ কম হয়। জমির পাশেই প্রবাহিত নদী থেকে খেতে পানি দেওয়া দেওয়া যায়। এ ছাড়া চরের জমিও উর্বর। এ জন্য ফলন ভালো হয়।
মান্দা বিষ্ণুপুর এলাকায় আত্রাই নদীর চরে ভুট্টার জমিতে সেচ দিচ্ছিলেন উপজেলার

চকরামপুর মধ্যপাড়া গ্রামের আবদুল হান্নান। তিনি বলেন, ‘হামি সারা বছর অন্যের জমিতে কাম করে সংসার চালাই। কয়েক বছর হলো শুকনা মৌসুমত নদীর চরত ভুট্টা, আলু ও মরিচের আবাদ করোছি। চরের জমি খুব ভালো। অল্প সার দিলেই হয়। পানিও সহজে পাওয়া যায়।’

শুষ্ক মৌসুমে খাল-বিলের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় আরও কিছু চাষযোগ্য জমি বের হয়। নদীর চরের জমি খুবই উর্বর; ফলনও বেশি হয়। কৃষকদের মধ্যে নদীর চরে ফসল ফলানোর আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে।
আবুল কালাম আজাদ, নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপপরিচালক

কালিকাপুর ইউনিয়নের শলিয়া ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা কে এম মাহাবুব হোসেন জানান, বেশ কয়েক বছর ধরে কৃষকেরা আত্রাইয়ের দুই তীরে বিভিন্ন প্রকার রবি ফসল আবাদ করছেন। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদের সার্বিক সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে।

নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, জেলায় আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় আড়াই লাখ হেক্টর। শুষ্ক মৌসুমে খাল-বিলের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় আরও কিছু চাষযোগ্য জমি বের হয়। নদীর চরের জমি খুবই উর্বর; ফলনও বেশি হয়। কৃষকদের মধ্যে নদীর চরে ফসল ফলানোর আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। কৃষকেরা যাতে ভালো ফসল ফলাতে পারেন, সে জন্য কৃষকদের সার্বক্ষণিক পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।