চিকিৎসক কম, নানা সংকট

দরিদ্র মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা থেকে। হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম বেহাল।

রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসাসেবা চালু হয় ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত এ হাসপাতালে কোনো আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) পদায়ন হয়নি। অস্ত্রোপচারকক্ষ (ওটি) থাকলেও অস্ত্রোপচারও হচ্ছে না। পাঁচ বছরে চিকিৎসকের অর্ধেক পদ শূন্য থেকেছে। মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পদ পাঁচটি, কর্মরত রয়েছেন দুজন। আয়া পদ দুটি, দুটিই শূন্য।

এভাবেই চলছে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কার্যক্রম। এর বাইরে শুরু থেকেই পরিচ্ছন্নতাকর্মীর পদ সৃষ্টি করা হয়নি। নৈশপ্রহরীর পদও নেই। রোগী ও তাঁদের স্বজনদের নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রান্তিক মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ব্রত নিয়ে ৫০ শয্যার এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের যাত্রা শুরু হলেও দরিদ্র মানুষজন বঞ্চিত হচ্ছেন কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা থেকে।

সিভিল সার্জন কার্যালয় ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালের ১৬ নভেম্বর পাংশা উপজেলা ভেঙে সাতটি ইউনিয়ন নিয়ে কালুখালী উপজেলা গঠিত হয়। ২০১৩ সালের ২ নভেম্বর পাংশা কলেজ মাঠে জনসভা থেকে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বোয়ালিয়া ইউনিয়নের সোনাপুর মোড় এলাকায় প্রায় ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে এটি নির্মাণ করা হয়। তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স উদ্বোধন করেন।

অস্ত্রোপচারকক্ষের অধিকাংশ যন্ত্রপাতি আছে। তবে অচেতন করার যন্ত্রটি নেই। এ ছাড়া অ্যানেসথেটিস্ট ও সার্জারি বিশেষজ্ঞ নেই। এতে করে অপারেশন থিয়েটার চালু করা যাচ্ছে না। জটিল রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া যাচ্ছে না।
ফারজানা ইসলাম, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১০ জন চিকিৎসকের পদ রয়েছে। এর মধ্যে একজন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, আরএমও একজন, জুনিয়র কনসালট্যান্ট মেডিসিন, গাইনি, অ্যানেসথেসিয়া, সার্জারি একজন করে, চিকিৎসা কর্মকর্তা তিনজন এবং একজন সহকারী ডেন্টাল সার্জনের পদ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আরএমওসহ জুনিয়র কনসালট্যান্ট মেডিসিন, অ্যানেসথেসিয়া, সার্জারি পদ শূন্য রয়েছে। জুনিয়র কনসালট্যান্ট গাইনি যোগদান করেছেন এক মাস আগে।

পাঁচ বছরেও অর্ধেক চিকিৎসক পদ শূন্য থাকায় সাতটি ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসা কর্মকর্তারা এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দায়িত্ব পালন করছেন। উপজেলার মৃগী, রতনদিয়া, খাগজানা উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে একজন করে চিকিৎসা কর্মকর্তা এবং মাঝবাড়ী, সাওরাইল, কালিকাপুর ও মদাপুর উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে একজন করে সহকারী সার্জনের পদ রয়েছে।

এ ছাড়া এ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মিডওয়াইফ তিনটি পদই শূন্য রয়েছে। মেডিকেল টেকনোলিজিস্ট (রেডিও), মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (বিসিজি/ইপিআই), স্টোরকিপার, পরিসংখ্যানবিদ, চালক, জুনিয়র মেকানিক, ওয়ার্ড বয় দুজন, আয়া দুটি পদই ফাঁকা। কুক দুটি পদের মধ্যে একটি ফাঁকা রয়েছে। মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্য পরিদর্শকের একটি পদ থাকলেও তা শূন্য রয়েছে। সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শকের তিনটি পদের বিপরীতে দুজন কর্মরত। স্বাস্থ্য সহকারী ২১টি পদের বিপরীতে ১৮ জন কর্মরত আছেন।

ভুক্তভোগীদের কথা

১ মার্চ ভর্তি থাকা রোগী ও তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে কথা হয়। একাধিক রোগীর স্বজনেরা অভিযোগ করেন, হাসপাতালটি খুব নোংরা। শৌচাগারের সামনের বারান্দায় পানি জমে আছে। ভেতরের অবস্থা আরও ভয়াবহ। শৌচাগারে কোনো সুস্থ মানুষ গেলেও অসুস্থ হয়ে যাবে। ঠিকমতো পরিষ্কার করা হয় না।

মাকে চিকিৎসা করাতে নিয়ে এসেছিলেন বোয়ালিয়ার বাসিন্দা জিহাদুল ইসলাম। তিনি বলেন, হাসপাতালটি মহাসড়কের পাশে। মহাসড়কে যখন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তখন রোগীদের দ্রুত এখানে এনে অস্ত্রোপচার করার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই। অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হয়েছে, কিন্তু চালক নেই। এতে করে জরুরিভাবে রোগী রাজবাড়ী বা ফরিদপুর নেওয়ার ক্ষেত্রেও ঝামেলা পোহাতে হয়।

আরেক রোগীর স্বজন শহীদুল ইসলাম বলেন, এখানে অস্ত্রোপচার না হওয়ায় প্রসূতিদের সিজার করানো হয় না। প্রসূতিদের বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিকে যেতে হয়েছে। এতে করে দরিদ্র পরিবারগুলোকে অনেক টাকা খরচ হতো। মিডওয়াইফ ও গাইনি চিকিৎসক না থাকায় আগে নরমাল ডেলিভারিও করানো হতো না। এখন একজন গাইনি চিকিৎসক অবশ্য এসেছেন।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হারুন অর রশিদ বলেন, শৌচাগারের নিচের পাইপ মাস তিনেক আগে ফেটে গেছে। কল ছাড়লে পুরো এলাকা পানিতে ভেসে যায়। এই শৌচাগার ব্যবহার করতে না পারায় বিশেষ করে নারীদের খুব সমস্যা পোহাতে হয়। টাইলস ভেঙে পাইপ মেরামত করতে হবে। অথবা বাইরে দিয়ে দিয়ে পাইপ নিতে হবে। এ জন্য বেশ টাকা লাগবে।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ফারজানা ইসলাম বলেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অস্ত্রোপচারকক্ষের অধিকাংশ যন্ত্রপাতি আছে। তবে অচেতন করার যন্ত্রটি নেই। এ ছাড়া অ্যানেসথেটিস্ট ও সার্জারি বিশেষজ্ঞ নেই। এতে করে অপারেশন থিয়েটার চালু করা যাচ্ছে না। জটিল রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া যাচ্ছে না। আরেকটি বড় সমস্যা হলো পরিচ্ছন্নতাকর্মী নেই। নৈশপ্রহরীও নেই। বাইরে থেকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী এনে পরিষ্কার করা হয়। তাঁদের আলাদা তহবিল থেকে মজুরি দেওয়া হয়। এ কারণে হাসপাতালটিকে সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা সম্ভব হয় না। নৈশপ্রহরী না থাকায় প্রায়ই বাইরের টিউবওয়েলের মাথা চুরি হয়ে যায়। আর শৌচাগারের পাইপ মেরামত করতে ২৫-৩০ হাজার টাকার মতো লাগবে। বিষয়টি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে জানানো হয়েছে।

সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ইব্রাহিম টিটন বলেন, ‘ওই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যানেসথেটিস্ট নেই। অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও চালক নেই। যন্ত্রপাতির আগে প্রয়োজন চিকিৎসক। আমরা চিকিৎসকের বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।’