উত্তরের তিন জেলায় বিপৎসীমার ওপর কয়েকটি নদ-নদীর পানি, বন্যার শঙ্কা

কুড়িগ্রামে উজানের ঢলে তিস্তা ও দুধকুমার নদের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যাত্রাপুর নৌকাঘাট এলাকা থেকে তোলাছবি: প্রথম আলো

টানা ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে উত্তরাঞ্চলের চার জেলায় নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তিস্তাসহ প্রধান নদ-নদীর পানি কয়েকটি স্থানে বিপৎসীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী কয়েক দিন অবিরাম বর্ষণের সম্ভাবনা থাকায় রংপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামের বন্যা পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর মধ্যে রংপুর, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম—এই তিন জেলার কয়েকটি নদ-নদীর পানি বিভিন্ন পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে নীলফামারীতে পানির প্রবাহ বিপৎসীমা অতিক্রম না করলেও পানি বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

রংপুর

রংপুরে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আজ বুধবার বেলা ১১টায় কাউনিয়া উপজেলার তিস্তা রেলসেতু এলাকায় তিস্তার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে। সেখানে আজ রাতের মধ্যে পানি আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

আজ সকালে রংপুরের পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, আগামী ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মাঝারি ও ভারী বৃষ্টি হতে পারে। এ সময় তিস্তার পানি আরও বাড়তে পারে। গতকাল মঙ্গলবার মধ্যরাতে রংপুরে ২২১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আজ সকাল থেকে আকাশে কালো মেঘ দেখা গেছে। সেই সঙ্গে থেমে থেমে মেঘের গর্জনও আছে।

রংপুর পাউবোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহসান হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, পানি বাড়ার আশঙ্কায় তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দেওয়া হয়েছে।

জেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানরা জানান, তিস্তার নদীর পানি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় জেলার গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার নদী–তীরবর্তী এলাকায় বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় নদীপাড়ের বাসিন্দারা সতর্কাবস্থায় আছেন।

রংপুরে পানিতে তলিয়ে গেছে পাকা ধানখেত। তড়িঘড়ি করে ধান কেটে নিচ্ছেন এক চাষি। ছবিটি রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার মীরবাগ এলাকা থেকে তোলা
ছবি: মঈনুল ইসলাম

গঙ্গাচড়ার লক্ষ্মীটারী ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল্লাহেল হাদী বলেন, তিন দিন ধরে নদীর পানি বাড়ছে। আকাশের পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, নদীর পানি আরও বাড়বে।
তিস্তা নদী–তীরবর্তী কোলকোন্দ, নোহালী ও আলমবিদিতর ইউনিয়নের বাসিন্দারা বন্যার ঝুঁকির মধ্যে আছেন বলে জানান সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানরা।

পাউবোর ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আসফাউদদ্দৌলা বলেন, তিস্তা নদীর পানি কয়েক দিনের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। আজ সকাল ছয়টায় পানি বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সন্ধ্যার পর পানি কিছুটা বাড়তে পারে, তবে বিপৎসীমা অতিক্রম করার আশঙ্কা কম।

নীলফামারী

আজ সকালে নীলফামারীর তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পানি কমতে থাকে। তবে বৃষ্টি না থামায় নদীর পানি যেকোনো সময় বিপৎসীমা অতিক্রম করে লোকালয় প্লাবিত করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন নদী–তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দারা।

জেলা পাউবোর ডালিয়া ডিভিশনের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সূত্র জানায়, লালমনিরহাট জেলার দোয়ানীতে অবস্থিত তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে আজ সকাল ৬টায় তিস্তার পানি প্রবাহিত হয় ৫১ দশমিক ৯৫ মিটার। সকাল ৯টায় ৩ সেন্টিমিটার কমে ৫১ দশমিক ৯২ মিটার এবং দুপুর ১২টায় আরও ৪ সেন্টিমিটার কমে ৫১ দশমিক ৮৮ মিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ওই পয়েন্টে তিস্তা নদীর বিপৎসীমা ৫২ দশমিক ১৫ মিটার। সন্ধ্যা ছয়টার পর পানি কিছুটা বাড়ার আশঙ্কা আছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. রবিউল ইসলাম বলেন, ‘পানি বৃদ্ধি পেলেও চরাঞ্চলের বাড়িঘরে এখনো পানি ওঠেনি। তবে যেকোনো সময়ের মধ্যে পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।

নীলফামারী জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। আজ সকালে লালমনিরহাট জেলার দোয়ানীতে অবস্থিত তিস্তা ব্যারাজ পয়েণ্টে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ২০ সেণ্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল
ফাইল ছবি

কুড়িগ্রাম


কুড়িগ্রামে প্রধান নদ-নদীগুলোর মধ্যে তিস্তা নদী ও দুধকুমার নদের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আজ সকাল ৯টায় পাটেশ্বরী পয়েন্টে দুধকুমার নদের পানি বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার এবং কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এ ছাড়া অন্য নদ-নদীর পানি বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। দুধকুমার নদের পানি বেড়ে নাগেশ্বরী উপজেলার চর লুচনী ও টেপারকুঠি এলাকায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।

দুধকুমার নদের পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় তীব্র স্রোতের তোড়ে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নের প্রথম আলো চরে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। এক সপ্তাহের ভাঙনে কয়েকটি পরিবার ভিটেমাটি হারিয়ে প্রথম আলো চর আলোর পাঠশালা ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাঠে ঠাঁই নিয়েছে। ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে প্রথম আলো চর আলোর পাঠশালা, রসুলপুর মাদ্রাসা ও বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দুটি সোলার পাম্পসহ দুই শতাধিক পরিবার।

দুধকুমার নদের পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় তীব্র স্রোতের তোড়ে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নের প্রথম আলো চরে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। এক সপ্তাহের ভাঙনে কয়েকটি পরিবার ভিটেমাটি হারিয়ে প্রথম আলো চর আলোর পাঠশালা ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাঠে ঠাঁই নিয়েছে।

কুড়িগ্রাম বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সহকারী প্রকৌশলী আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর বরেন্দ্রের ভূ–উপরিস্থ সেচ প্রকল্পের সোলার পাম্প দুটি দুধকুমার নদের ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছিল। তাঁরা পাউবোর সেচপাম্প দুটি রক্ষার জন্য চিঠি দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ বছরও সেচপাম্প দুটি ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে।

নাগেশ্বরী উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের ৪ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এ উপজেলার চর লুচনী, আনন্দবাজার, টেপারকুঠি, বিষ্ণুপুর গ্রাম, আনন্দবাজার, বন্ধুবাজার ও কালীগঞ্জ ইউনিয়নের ঢেপঢেপি, কৃষ্ণপুর, নামাপাড়া, নুনখাওয়া ইউনিয়নের কাঠগিরিরচর ও ফকিরপাড়া গ্রাম প্লাবিত হওয়ায় স্থানীয় লোকজন ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন। তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে থাকায় রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা বুড়িরহাট স্পার বাঁধ ভাঙনের ঝুঁকির মুখে।

গাইবান্ধা

গাইবান্ধার সব নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে জেলার চারটি নদ-নদী ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট, তিস্তা ও করতোয়ার পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় তিস্তার পানি বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্য তিনটি নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

গাইবান্ধা পাউবোর নিয়ন্ত্রণকক্ষের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ফুলছড়ি উপজেলার তিস্তামুখঘাট পয়েন্টে ৪৮ সেন্টিমিটার, ঘাঘট নদের পানি জেলা শহরের নতুন ব্রিজ পয়েন্টে ৫০ সেন্টিমিটার, করতোয়ার পানি গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার চকরহিমাপুর পয়েন্টে ৬ সেন্টিমিটার এবং তিস্তার পানি সুন্দরগঞ্জ উপজেলাসংলগ্ন কাউনিয়া পয়েন্টে ৩৯ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। গতকাল দুপুর ১২টা থেকে আজ দুপুর ১২টা পর্যন্ত এই পরিমাণ পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় তিস্তার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। আজ দুপুরে এ নদীর পানি বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

গাইবান্ধার চারটি নদী ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট, তিস্তা ও করতোয়ার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বুধবার দুপুরে ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের বালাসিঘাট এলাকা থেকে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

গাইবান্ধা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী হাফিজুল হক বলেন, পানি বৃদ্ধির কারণে নদী–তীরবর্তী চরাঞ্চলে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। তবে আপাতত বড় বন্যার আশঙ্কা নেই।
অন্যদিকে নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি, ঘাগোয়া, ফুলছড়ি উপজেলার এরান্ডাবাড়ি, ফজলুপুর, কঞ্চিপাড়া ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তারাপুর, হরিপুর ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকতে শুরু করেছে।

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন রংপুর অফিস; নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা প্রতিনিধি)