মৌলভীবাজারে কমছে শীতের পিঠার উপকরণ ‘আখের রস’
মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার মনু নদের উত্তর পাশে ভাঙার হাট এবং দক্ষিণ পাশে মিঠিপুর। মিঠিপুর উপজেলার কামারচাক ইউনিয়নের একটি গ্রাম। মিঠার উৎস এই মিঠিপুর থেকে আসছে আখমাড়াই যন্ত্রের শব্দ। প্রায় হারিয়ে যাওয়া এই আখ ফসল এখনো এই গ্রামের কিছু কৃষকের আগ্রহ, আদর-যত্নে টিকে আছে।
শীত এলেই পিঠাপুলি তৈরির অন্যতম একটি উপাদান হচ্ছে এই ‘আখের রস’, যা দিয়ে রসের ক্ষীর, রসের পিঠা হয়। আর রস পান তো আছেই।
সম্প্রতি এক ভোরের আলো কিছুটা বাড়তেই মাঝি ফিরলেন ঘাটে। তারপর নৌকা চড়ে ওপারে, মিঠিপুরে। ঘাট পার হতেই দেখা মিলে রসের পাইকারদের। কাঁধভারে টিনে করে আখের রস নিয়ে তাঁরা দূরদূরান্তের গ্রামের দিকে ছুটে চলছেন। সকাল সকাল গ্রাহকের কাছে না পৌঁছালে রস নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ফেরি করে তাঁরা এই রস বিক্রি করবেন।
সকালে তখন আখচাষি জহিরুল ইসলামের বাড়ির উঠানের একপাশে যন্ত্রে আখমাড়াই চলছে। মাড়াই যন্ত্রের একদিক দিয়ে আখ ঢোকানো হচ্ছে, অপর দিকে ছোবড়া বেরিয়ে স্তূপ জমছে। আর নিচের দিকে নির্দিষ্ট স্থানে জমা হচ্ছে আখের রস। সেই রস পাইকারদের টিনে টিনে মেপে তুলে দেওয়া হচ্ছে। গ্রামের লোকজন রসপিঠা, ক্ষীরের জন্য আখের রস নিতে বোতল নিয়ে এসেছেন।
গ্রামবাসীর চাহিদামতো রস দেওয়া হচ্ছে। বাড়ির পাশেই একটি আখখেত। খেতের আখ অনেকটা এরই মধ্যে কেটে ফেলা হয়েছে। শুকনা পাতা খেতের মধ্যে পড়ে আছে। দু–তিনজন আখ কেটে মাড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করছেন। পাশে সারি সারি আখের গাছ দাঁড়িয়ে আছে। অনেকগুলো আখগাছের মাথায় কাশফুলের মতো ফুল ফুটেছে।
জহিরুল ইসলাম বলেন, তিনি ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই আখ মাড়াই শুরু করেছেন। সকাল থেকেই শুরু হয় তাঁদের কাজ। শুরুতে আখ মাড়াই, তারপর অন্যগুলো করেন। সকালে খুচরা বিক্রির জন্য বিভিন্ন স্থানের পাইকারেরা আখের রস নিতে আসেন। তাঁদের রস দেওয়ার পর চুলায় বড় কড়াইয়ে বসানো হয় বাড়তি রস। জ্বাল দিয়ে তৈরি করা হয় নিখাদ খাঁটি গুড় ও তরল ‘লালি’। এই রস, গুড় ও লালি—সবটাই পাইকারেরা বাড়ি থেকে এসে নিয়ে যান। অনেক সময় গ্রাহকের চাহিদামতো হাটে বা নির্দিষ্ট স্থানে তা পৌঁছে দেওয়া হয়।
জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘৩৫-৩৬ বছর ধরে আমি আখ চাষ করছি। বাবার পর থাকি আখের চাষ ধরে রাখছি। তবে আখ চাষ অনেক পরিশ্রমের। এখন লোক পাওয়া যায় না। আখ কাটার সময় অন্তত তিনজন মানুষের দরকার অয় (হয়)। আখ কাটতে অয়, মেশিনে দিতে অয়। রস জ্বাল দেওয়ার জন্য ছোবড়া শুকাতে অয়। এসব কারণে এখন অনেকে আখ চাষ করতে চায় না।’
এই আখচাষি বলেন, তাঁদের গ্রাম মিঠিপুর নামকরণের সঙ্গেও এই আখের সম্পর্ক আছে। অনেককাল আগে থেকেই মিঠিপুরে প্রচুর আখ চাষ হয়ে আসছে। এই ফলের রস মিঠা হওয়ায় গ্রামের নাম হয়ে গেছে মিঠিপুর। তবে এখন আখ চাষ অনেক কমে গেছে। তিনি তিন কিয়ার (৩০ শতাংশ = ১ কিয়ার) জমিতে আখ চাষ করেছেন। প্রায় ৫৫ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। এ পর্যন্ত এক লাখ টাকার মতো বিক্রি করেছেন। আরও দেড় লাখ টাকার মতো বিক্রি করতে পারবেন বলে ধারণা করছেন। প্রায় ২০ বছর ধরে তিনি মহিষের বদলে যন্ত্র দিয়ে আখ মাড়াই করছেন। নিজের খেতের আখমাড়াই ছাড়াও ভাড়ায় অন্যদের আখও মাড়াই করেন।
গ্রামের ছমির খান বলেন, ‘আগে ছাপে (সবাই) খেত (আখের) করত। রাস্তার দুই সাইটে খেত থাকত। রাস্তা দিয়া দিনে যাইতেও ডর করত। এখন অনেক কমে গেছে।’
স্থানীয় কয়েকজন বললেন, মনুপারের মিঠিপুরসহ আশপাশের গ্রামে শত বছরের বেশি সময় ধরে আখ চাষ হয়ে আসছে। এখানে প্রতি লিটার আখের রস ৬০ টাকা, প্রতি কেজি গুড় ২৫০ টাকা এবং লালির কেজি ২২০ টাকা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. জালাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেলায় সামান্য আখের চাষ হয়ে থাকে। তবে সমতল ভূমিতে আখ চাষ করার সুযোগ আছে। আখের পাশাপাশি সাথী ফসলও চাষ করা যেতে পারে।’