আবু সাঈদের লাশ নিয়ে সেদিন কী হয়েছিল
গত বছরের ১৬ জুলাই। বেলা তখন ৩টা ৫ মিনিট। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে মৃত্যুর সনদে লেখা হয় আবু সাঈদের নাম। মৃত্যুর কারণ ইংরেজিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্রড ডেড। অর্থাৎ হাসপাতালে আনার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
আবু সাঈদের বন্ধুবান্ধব ও আন্দোলনের সহযোদ্ধারা বলছেন, বন্দুকের সামনে বুক পেতে দেওয়া আবু সাঈদ যখন গুলিবিদ্ধ হন, তখন বেলা ২টা ১৮ মিনিট। তাঁকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নেন কয়েকজন সহযোদ্ধা। জরুরি বিভাগ থেকে তাঁকে নেওয়া হয় সার্জারি বিভাগে। সেখানে চিকিৎসক ইসিজি করার পর মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হন। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আবু সাঈদের মৃত্যুর খবরটি প্রকাশ করছিল না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ আবু সাঈদকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাঁকে প্রথমে ব্যাটারিচালিত রিকশায়, এরপর ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে যান সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের (মার্ক্সবাদী) রংপুর জেলার আহ্বায়ক সাজু বাসফোর, মাহীগঞ্জ কলেজের শিক্ষার্থী নিপুণ রায় ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন শিক্ষার্থী।
সাজু বাসফোর সেদিনের কথা স্মরণ করে প্রথম আলোকে বলেন, আবু সাঈদকে রিকশায় নেওয়া হলেও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পার হয়ে বিএডিসি কার্যালয়ের কাছে তাঁকে আর রিকশায় রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। তখন তাঁকে ব্যাটারিচালিত অটোতে করে লালবাগ ও শাপলা চত্বর পার হয়ে কোতোয়ালির থানার সামনে দিয়ে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার পরই আবু সাঈদের শরীর নিথর হয়ে যায়। তাঁর নাক, মুখে তখন রক্ত জমাট বাধা ছিল। দুই হাতে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ ছিল। রংপুর মেডিকেলে পৌঁছে তাঁকে জরুরি বিভাগে নেওয়া হলে সেখান থেকে সার্জারি বিভাগে পাঠানো হয়। সার্জারি বিভাগে ইসিজি করে চিকিৎসক কিছু জানাচ্ছিলেন না। তিনি শুধু পরিচালকের কথা বলছিলেন।
রংপুর মেডিকেল হাসপাতালে আবু সাঈদকে নেওয়া হলে সেখানে ছিলেন রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রাইসুল ফারিদ। তিনি বলেন, ‘যখন ডাক্তার বলল, উনি আর বেঁচে নেই, তখন ডাক্তারকে বলি আমরা লাশটা নিতে পারব কি না। উনি বললেন, আমাদের কাগজের ফর্মালিটি (নিয়মকানুন) আছে। এগুলো করে দিলে পারব। উনি বললেন, এ জন্য সময় লাগবে। আমরা বললাম, ৩০ মিনিটের ভেতরে দেখেন কাজটা করা যায় কি না। চিকিৎসক বলছিলেন, আরও কিছুক্ষণ সময় লাগবে। তখন আমরা আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। এর মধ্যে লাশের স্ট্রেচার ভবনের নিচে জরুরি বিভাগের সামনে আনা হয়েছিল। কিন্তু ৩০-৪০ মিনিট পার হয়। তাঁরা লাশ দিচ্ছিলেন না। এখানে মিটিং করতেছেন, ওখানে মিটিং করতেছেন। তাঁরা শুধু বলছেন, সময় লাগবে।’
তবে ওই সময়ের দায়িত্বরত চিকিৎসকদের নাম জানাতে পারেননি শিক্ষার্থীরা। তাই তাঁদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
লাশ নিয়ে মিছিল
ওই দিনের আন্দোলনকারী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য মতে, আবু সাঈদের লাশ নিয়ে বিকেল পৌনে চারটা অথবা চারটার দিকে জরুরি বিভাগের সামনে থেকে বের হন সংক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। তাঁরা মেডিকেল কলেজ থেকে লাশ নিয়ে মিছিল করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাচ্ছিলেন। ওই সময়ের কয়েকটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিয়ে স্ট্রেচারে সাদা কাপড়ে ঢাকা আবু সাঈদের লাশ নিয়ে যাচ্ছিলেন।
একটি ভিডিওতে দেখা যায়, আবু সাঈদের সহপাঠীরা ‘আমার ভাই মরল কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘পুলিশ কেন গুলি করল, প্রশাসন জবাব চাই’—ইত্যাদি স্লোগান দিচ্ছিলেন।
রাইসুল ফারিদ বলতে থাকেন, ‘আমরা ৩০-৩৫ জন জরুরি বিভাগ হয়ে রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে দিয়ে লাশ নিয়ে মিছিল বের করলাম। হাসপাতালের দু-তিনজন এসে বাধা দেয়। তাদের বাধা অতিক্রম করে আধা কিলোমিটার মিছিল নিয়ে এলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মোড়ে থামানোর চেষ্টা করে পুলিশ। পুলিশি বাধা অতিক্রম করে জেলা স্কুল মোড়ে গেলে সেখানে আটকানোর চেষ্টা করা হয়। পরে আমাদের থামাতে পারেনি। পুলিশ লাইনসের মোড়ে গেলে একটি বড় ভ্যানে এসে পুলিশ সদস্যরা বাধা দেয়। লাশ নিয়ে ক্যাম্পাসে যাব বললে ওরা লাশ চায়। আমরা লাশ দেব না। আমরা রাস্তায় শুয়ে পড়ি। তখন কথা-কাটাকাটি ও ধাক্কাধাক্কি হয়। শেষমেশ আমরা পারিনি।’
সেই মিছিলে ছিলেন বাসদের (মার্ক্সবাদী) রংপুরের সংগঠক আহসানুল আরেফিন। তিনি বলেন, পুলিশ লাইনস মোড়ে একাধিক ভ্যান নিয়ে এসে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে লাশ কেড়ে নেওয়া হয়। এ সময় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানো হয়। পরে শিক্ষার্থীরা কাচারিবাজারে অবস্থান নেন। ওই দিনের ঘটনায় অপেশাদারি আচরণ করা পুলিশ সদস্যরা কে কোথায় আছেন, তা খুঁজে বের করে তাঁদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান আহসানুল আরেফিন।
এ বিষয়ে রংপুর মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. মজিদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই বিষয়ে কয়েকটি মামলা হয়েছে। এটা আমার ইউনিটে তদন্তাধীন নয়। আবু সাঈদের মামলাটি তদন্ত করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। অন্যান্য অভিযোগগুলো পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত করছে। তাঁদের তদন্তের বিষয়ে আমি কমেন্ট (মন্তব্য) করলে ওটা প্রাসঙ্গিক হয় না।’
লাশ নিয়ে লুকোচুরি
শিক্ষার্থীদের মিছিল থেকে আবু সাঈদের মরদেহ পুলিশ আবার হাসপাতালে ফিরিয়ে নিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই হিমঘরের আশপাশে অপেক্ষা করেন। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ তাঁর মরদেহ হাসপাতাল থেকে গ্রহণ করা, মরদেহ বাসায় পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘তখন সন্ধ্যা ৭টার মতো বাজে। মরদেহ নেওয়ার ব্যাপারে হাসপাতাল প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলতে গেছি। বের হয়ে দেখি, একটি গাড়ি দ্রুত চলে গেল। কে গেল, তারা বলতে চাইতেছিল না। পরে আমরা বললাম, আবু সাঈদের মরদেহ কোথায়? তখন আমরা শুনলাম, তাঁর মরদেহ সরিয়ে ফেলা হয়েছে।’
আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী দাবি করেন, তাঁর ভাইয়ের লাশ নিতে ছাড়পত্র দেওয়ার কথা বলে তাঁদের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখান থেকে বের হয়ে এসে দেখেন, লাশ আর আগের জায়গায় নেই। কোনো লোকের খোঁজ নেই। লাশও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। কমপক্ষে ৩ থেকে সাড়ে ৩ ঘণ্টা লাশ খুঁজেছেন তাঁরা। পরে মর্গে গিয়ে সেই লাশের খবর পান।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ১০ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। এ সময় বিভিন্ন অভিযোগে হাসপাতালটির তৎকালীন পরিচালক মোহাম্মদ ইউনুস আলীসহ ৪ কর্মকর্তাকে ওএসডি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মহাখালীতে সংযুক্ত করা হয়।
আবু সাঈদের লাশ নিয়ে লুকোচুরির বিষয়টি জানা নেই বলে মন্তব্য করেন বর্তমান পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশিকুর রহমান।
আবু সাঈদের লাশের পিছু পিছু
গত বছরের ১৬ জুলাই রাত ১২টার দিকে ময়নাতদন্ত শেষ হলে আবু সাঈদের বাড়ির দিকে মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স রওনা দেয়। মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্সের সামনে ও পেছনে র্যাব, পুলিশসহ ১৮টি সরকারি গাড়ি ছিল। এর বাইরে দুটি মাইক্রোবাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক ও আবু সাঈদের স্বজনেরা যান।
ওই রাতে আবু সাঈদের লাশের গাড়ির পেছনে মোটরসাইকেলে ছিলেন এই প্রতিবেদক। লাশের গাড়িবহর রংপুর-ঢাকা মহাসড়ক ধরে পীরগঞ্জের চৌহাটে পৌঁছে একটি ফিলিং স্টেশনে ৩৫-৪০ মিনিট বিরতি নেয়। ওই বিষয়ে আবু সাঈদের ভাই রমজান আলী বলেন, গাড়িগুলো থামলে তিনি নেমে গাড়ির লোকজনকে জিজ্ঞাসা করেন, কেন থামানো হয়েছে। একজন তখন তাঁকে বলেছিলেন, ‘আপনাদের বাড়ির দিকের অবস্থা বেশি ভালো নয়। খুব উত্তেজিত অবস্থা। এ কারণে আমরা একটু এখানে ওয়েট (অপেক্ষা) করছি।’
পীরগঞ্জ থেকে খালাশপীর সড়কে পড়েছে আবু সাঈদের বাবনপুর গ্রাম। পীরগঞ্জ থেকে ওই পথ ধরে তাঁর বাড়িতে যেতে দেখা গেছে, গভীর রাতে রাস্তার মোড়ে মোড়ে মানুষ জেগে আছে। জাফরপাড়া বাজার থেকে মাত্র ৫০০ গজ দূরে আবু সাঈদের বাড়ি হলেও সেখানে যায়নি প্রশাসনের কোনো গাড়ি।
রাতে লাশ দাফন করতে চাপ
আবু সাঈদের পরিবারের দাবি, রাতে লাশ দাফন করতে ইউএনও, চেয়ারম্যান, মেম্বার ও আওয়ামী লীগ নেতাদের তরফ থেকে চাপ ছিল। আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন বলেন, প্রশাসনের লোকজন ভেকু দিয়ে কবর খুঁড়ে দিতে চেয়েছিল। প্রশাসনের খুব চাপের মুখে সকাল ৭টার সময় জানাজার সময় ঠিক করা হয়। কিন্তু তাঁর ছেলেরা জানাজার সময় ৭টার বদলে ৯টা নির্ধারণ করে মাইকিং করেন। তখন প্রশাসনের তরফ থেকে আপত্তি জানানো হয়।
প্রথম আলোর ওই সময়ের খবরে বলা হয়, ‘ঘড়ির কাঁটায় ৯টা বাজতেই জানাজা পড়ানো তাগিদ দেন ইউএনও ইকবাল হাসান (তৎকালীন)। কিন্তু বাদ সাধেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপস্থিত কয়েকজন শিক্ষার্থী। এতে খানিকটা হট্টগোল হয়। একপর্যায়ে ইউএনওর নির্দেশে হট্টগোলের মধ্যেই কিছু লোক নিয়ে জানাজা শুরু করা হয়।’ হট্টগোলের মধ্যেই ইউএনও জানাজা শেষ করে লাশ দাফনের উদ্দেশ্যে নিতে চাইলে উপস্থিত লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। ইউএনও তখন লাশ সেখানে রেখে ঘটনাস্থল ছেড়ে যান।