অভিযানে গিয়ে ‘জিম্মি’ ভ্রাম্যমাণ আদালত

মানিকগঞ্জ জেলার মানচিত্র

মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলায় পদ্মা নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) তাপসী রাবেয়া ও তাঁর সহযোগীরা। এক বালু ব্যবসায়ীর লোকজন ভ্রাম্যমাণ আদালতবাহী স্পিডবোটকে একপ্রকার জিম্মি করে অন্যত্র নিয়ে যান। গত মঙ্গলবার বিকেলে উপজেলার আজিমনগর ইউনিয়নে পদ্মা নদীতে এ ঘটনা ঘটে।

তাপসী রাবেয়া গতকাল বুধবার রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাটি তিনি জেলা প্রশাসককে জানিয়েছেন। আজ বৃহস্পতিবার উপজেলায় ঢাকা থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হরিরামপুরে আসবেন। বিষয়টি সেখানেও উপস্থাপন করা হবে। তিনি বলেন, ‘দোহারের লোকজন বালু উত্তোলন করছেন। তবে তাঁদের চিনি না। ঘটনার সঙ্গে জড়িত লোকজনের বাড়িও সেখানে।’

হরিরামপুর থানা-পুলিশ, উপজেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দুটি খননযন্ত্র দিয়ে বালু তোলা হচ্ছিল। খবর পেয়ে মঙ্গলবার বেলা তিনটার দিকে সেখানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) তাপসী রাবেয়া। এ সময় স্পিডবোটে তাঁর সঙ্গে ছিলেন হরিরামপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সুরেশ রাজবংশীসহ পুলিশের দুজন কনস্টেবল, একজন সশস্ত্র আনসার সদস্য এবং উপজেলা প্রশাসনের তিনজন কর্মচারী।

দোহারের লোকজন বালু উত্তোলন করছেন। তবে তাঁদের চিনি না। ঘটনার সঙ্গে জড়িত লোকজনের বাড়িও সেখানে।
তাপসী রাবেয়া, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি), হরিরামপুর 

প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন ব্যক্তি জানান, বিকেল চারটার দিকে নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সময় একটি খননযন্ত্র জব্দ করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। অপর একটি খননযন্ত্র জব্দ করার সময় দোহার এলাকা থেকে একটি স্পিডবোট ও একটি ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে করে অর্ধশতাধিক মানুষ এসে অভিযানের দায়িত্বে থাকা সবাইকে অবরুদ্ধ করেন। এরপর তাঁদের প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে দোহারের মৈনট ঘাটে নিয়ে যান।

খবর পেয়ে বিকেল পাঁচটার দিকে দোহারের সহকারী কমিশনার এস এম মোস্তাফিজুর রহমান মৈনট ঘাটে যান। এর আগে বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত লোকজন সেখান থেকে সটকে পড়েন। পরে জব্দ করা বাল্কহেডটি দোহারের সহকারী কমিশনারের জিম্মায় রেখে তাপসী রাবেয়া ও তাঁর সঙ্গে থাকা লোকজন হরিরামপুরে চলে আসেন।

ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে এসআই সুরেশ রাজবংশী প্রথম আলোকে বলেন, সহকারী কমিশনার তাপসী রাবেয়ার নেতৃত্বে তাঁরা নদীতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় গিয়েছিলেন। পরে তাঁদের অবরুদ্ধ করে মৈনট ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

হরিরামপুর থেকে আটক বাল্কহেডটি নিজেদের তত্ত্বাবধানে রেখেছেন বলে জানিয়েছেন দোহার উপজেলা সহকারী কমিশনার এস এম মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে নয়াবাড়ি ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম ওরফে শহীদ মিয়া জড়িত বলে তিনি শুনেছেন।

স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, চার বছর ধরে বর্ষা মৌসুমে হরিরামপুর উপজেলার ধুলশুড়া ও আজিমনগর ইউনিয়নে পদ্মা নদীর বিভিন্ন স্থানে একাধিক খননযন্ত্র (ড্রেজার) দিয়ে বালু উত্তোলন করে আসছেন শহিদুল ইসলাম ও তাঁর সহযোগীরা। শহিদুল ঢাকার দোহার উপজেলার নয়াবাড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। দেদার বালু উত্তোলনের ফলে নদী তীরবর্তী এলাকা ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। ইতিমধ্যে দুটি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ভাঙনের কবলে পড়েছে।

ভ্রাম্যমাণ আদালতকে হয়রানি করা লোকজন শহিদুলের অনুসারী বলে জানান হরিরামপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেওয়ান সাইদুর রহমান। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ধুলশুড়া ইউনিয়নে পদ্মা নদী থেকে খননযন্ত্র দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে তা বিক্রি করে আসছেন শহিদুল ও তাঁর লোকজন। এ কারণে নদীভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। এ বিষয়ে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। শহিদুলের সহযোগীরা মঙ্গলবার ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে বাধাদান, অভিযানকারীদের অবরুদ্ধ করে অন্যত্র নিয়ে হয়রানি করেন।

যোগাযোগ করা হলে শহিদুল প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় বাঁধের কাজের জন্য আগে দোহারের অংশে নদী থেকে খননযন্ত্র দিয়ে বালু তুলেছেন। তবে এখন বালু তুলছেন না। কারা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটিয়েছেন, তা তিনি জানেন না।

তবে দোহার উপজেলার নয়াবাড়ি ও চর মাহমুদপুর এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানান, শহিদুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর এলাকার কাছে পদ্মা নদীতে অবৈধভাবে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করছেন। ক্ষমতাসীন দলের নেতা হওয়ায় কেউ তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলে না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হরিরামপুর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে নয়টি নদীভাঙনের শিকার। এবার ধুলশুড়া ইউনিয়নে ভাঙন দেখা দিয়েছে। পদ্মার প্রবল স্রোত এবং অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে ভাঙন প্রবণতা বেড়েছে। সম্প্রতি উপজেলার ধুলশুড়া ইউনিয়নের আবিধারা গ্রামে চর মুকুন্দিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক-তৃতীয়াশ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এ ছাড়া ওই গ্রামের ১২টির বেশি বসতবাড়ি নদীগর্ভে চলে গেছে।