মায়া পেছনে ফেলে নীড়ের পথে হিমালয়ান শকুনটি

বরিশালে বাকেরগঞ্জে অবমুক্ত হওয়ার পর খোলা মাঠে ডানা মেলে ওড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল হিমালয়ান জাতের শকুনটি। গতকাল দুপুরে দাড়িয়াল গ্রামেছবি: প্রথম আলো

শকুনটি অবমুক্ত করার সময় পাশেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন সোলায়মান। মুক্ত আকাশে ডানা মেলতে পাখিটির বেশি সময় লাগল না। হিমালয়ান শকুনটি যত দূরে যাচ্ছে, বিষণ্নতা যেন তত আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরছে সোলায়মানকে। কেমন লাগছে জানতে চাইলে জবাবে তিনি বললেন, ‘এক মাস ধরে আমি শকুনটি পুষেছি, সেবা-যত্ন করেছি। ওর সঙ্গে আমার একটা ভিন্ন ধরনের সখ্য হয়েছিল, অন্য রকম একটা মায়া জন্মেছিল।’

টানা ২৩ দিন পর গতকাল সোমবার দুপুরে শকুনটির নীড়ে ফেরার অপেক্ষার অবশেষে অবসান হয়েছে। এ দিন বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার দাড়িয়াল গ্রামের একটি ফসলের মাঠে এটিকে অবমুক্ত করে প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ দল। অবমুক্ত করার আগে শকুনটির পাখায় স্যাটেলাইট যন্ত্র (স্যাটেলাইট আর্কাইভাল ট্যাগ) স্থাপন করা হয়।

আরও পড়ুন

এর আগে ৩০ নভেম্বর দুপুরে দাড়িয়াল গ্রামের বাসিন্দা সোলায়মানের বাড়ির ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় ঘরের চালায় ছিটকে পড়ে হিমালয়ান জাতের শকুনটি। এরপর শকুনটিকে উদ্ধার করে পরিচর্যা করে আসছিলেন তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যেরা।

সোলায়মান বলেন, ৩০ নভেম্বর দুপুরে ঘরের চালায় কিছু পড়ার শব্দ পান তাঁর স্ত্রী। বাইরে গিয়ে দেখেন, শকুনটি জবুথবু অবস্থায় পড়ে আছে। প্রাণীটিকে দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে সোলায়মানকে ফোন করে বিষয়টি জানান। পরে তিনি বাড়ি ফিরে দেখেন, অসুস্থ শকুনটি ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছে না। এরপর কাছে গেলেও শকুনটি তাঁকে ঠোকর দেয়নি। পরে শকুনটিকে ধরে বসতঘরের পাশে একটি ঘরে রেখে বন বিভাগকে খবর দেওয়া হয়। পরে বন বিভাগের স্থানীয় লোকজন শকুনটিকে পানি ও মুরগি খেতে দেওয়ার পরামর্শ দেন। এর পর থেকে প্রাণীটিকে নিয়মিত খাবার, পানি ও শুশ্রূষা দিয়ে আসছিলেন তাঁরা। প্রায় এক মাস পরিচর্যার পর শকুনটি ধীরে ধীরে সুস্থ-সবল হয়ে ওঠে।

অবমুক্ত করার আগে শকুনটির শারীরিক পরীক্ষা শেষে পিঠে স্যাটেলাইট যন্ত্র স্থাপন করছেন আইইউসিএনের কর্মীরা
ছবি: প্রথম আলো

গতকাল সোমবার দুপুরে আইইউসিএন বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞদের একটি দল সোলায়মানের বাড়িতে যান। তাঁরা প্রথমে শকুনটির শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওজন পরিমাপ করেন। এরপর সেটিকে অবমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। এ প্রসঙ্গে আইইউসিএন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ প্রোগ্রাম অ্যাসিস্ট্যান্ট কাজী জেনিফার আজমিরি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শকুনটি দু-এক দিন হয়তো এই এলাকায় থাকতে পারে। এরপর নিজের আবাসে ফিরে যাবে। গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য আমরা এটির পিঠে একটি স্যাটেলাইট যন্ত্র স্থাপন করে দিয়েছি।’

এ ধরনের শকুনের মূল বসতি হিমালয়সংলগ্ন তিব্বত ও চীন অঞ্চলে বলে জানান বিশেষজ্ঞ দলটির সদস্যরা। তাঁদের মতে, শীত মৌসুমে শকুনেরা নিজের বসতিতে খাবারসংকটে পড়ে। ফলে এগুলো তখন এদিকে চলে আসে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে বেশি যায়। পরিযায়ী পাখিদের মস্তিষ্কে নিজেদের আবাসের তথ্য সংরক্ষিত থাকে। তারা বিশেষ সূর্য এবং পৃথিবীর চুম্বকত্ব ব্যবহার করে সেই সব আবাসের পথ খুঁজে নিতে সক্ষম।

এসব কথার একপর্যায়ে শকুনটির কথা মনে পড়তেই সোলায়মান এবার বলে উঠলেন, ‘ক্ষুধা পেলে ঘরের মধ্যে কেমন অদ্ভুত আচরণ করত শকুনটি। আমি খাবার নিয়ে ঘর থেকে বের হলে ও ঘ্রাণ পেত। এ সময় ঘরের মধ্যে বেশ ছোটাছুটি করত। রাতে ঘুমোবার আগে ওর কষ্ট হচ্ছে কি না দেখে ঘুমাতে যেতাম। সকালে দোকানে যাওয়ার সময় খাবার দিয়ে যেতাম। দুপুরে এসে আবার খাবার দিতাম।’

স্বামীর কথায় সুর মিলিয়ে সোলায়মানের স্ত্রী মোহেসিনা সুলতানা বললেন, ‘বনের একটা প্রাণীর জন্য এত মায়া হবে—আগে বুঝতাম না; এখন বুঝি। কয়েকটা দিন ওর জন্য খারাপ লাগবে।’