চিকিৎসক-নার্স নেই, অফিস সহায়ক দিয়েই চলছে হাসপাতাল

সেন্ট মার্টিন দ্বীপে বাসিন্দা রয়েছে ১১ হাজারের মতো। দ্বীপের একমাত্র সরকারি হাসপাতালটিতে চিকিৎসক-নার্সসহ জনবল না থাকায় জরুরি চিকিৎসাসেবা পেতে বাসিন্দাদের দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে।

সেন্ট মার্টিন ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালছবি: প্রথম আলো

হাসপাতালে নেই চিকিৎসক-নার্স। কর্মরত রয়েছেন কেবল একজন অফিস সহায়ক (এমএলএসএস)। রোগী এলে বিনা মূল্যে বিতরণের জন্য রাখা কিছু ওষুধ বিতরণ করেন তিনি। এর বাইরে মেলে না কোনো স্বাস্থ্যসেবা। এমনই অবস্থা কক্সবাজারের টেকনাফের সেন্ট মার্টিন ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপে বাসিন্দা রয়েছেন ১১ হাজারের মতো। দ্বীপের একমাত্র সরকারি হাসপাতালটিতে চিকিৎসক-নার্সসহ জনবল না থাকায় জরুরি চিকিৎসাসেবা পেতে বাসিন্দাদের দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে।

টেকনাফের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেন্ট মার্টিনের ২০ শয্যার হাসপাতালটিতে অনুমোদিত জনবলের সংখ্যা ১৫। এর মধ্যে দুজন চিকিৎসক, চারজন নার্স, একজন ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান, একজন ফার্মাসিস্ট, একজন ওয়ার্ড বয়, একজন এমএলএসএস, একজন আয়া, একজন পিয়ন, একজন স্টোরকিপার, একজন নিরাপত্তা প্রহরী, একজন ঝাড়ুদারের পদ রয়েছে। তবে এসব পদের মধ্যে কেবল এমএলএসএস পদে রমজান আলী নামের এক ব্যক্তি কর্মরত। বাকি সব পদ শূন্য পড়ে রয়েছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০২ সালে দ্বীপের পশ্চিম পাড়ায় দেড় একর জমিতে প্রায় ছয় কোটি টাকা ব্যয়ে হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রশাসনিক ভবন ও চিকিৎসকের আবাসিক ডরমিটরি নির্মাণ শেষে ২০০৮ সালে হাসপাতালের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। প্রথমে ১০ শয্যা থাকলেও পরে একে ২০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। তবে ২৩ বছরেও হাসপাতালটিতে অন্তর্বিভাগে সেবা চালু হয়নি। ২০১৪ সালে ২৬ আগস্ট দস্তগীর হোসাইন নামের একজন চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়। যোগদানের পর তিনি কাউকে কিছু না বলে বিনা অনুমতিতে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যান। এরপর আর শূন্য পদে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ২০২০ সালের মার্চ থেকে স্বাস্থ্য ও লিঙ্গসহায়তা প্রকল্পের মাধ্যমে ১৬ জন এনজিও কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাধ্যমে হাসপাতালটিতে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছিল। এর মধ্যে মেডিকেল কর্মকর্তা ২ জন, চিকিৎসা সহকারী ২ জন, ধাত্রী ৪ জন, ল্যাব টেকনিশিয়ান ১ জন, কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কার ২ জন, গার্ড ২ জন, রাঁধুনি ১ জন, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ২ জন ছিলেন। গত বছরের ৩০ জুন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আবারও চিকিৎসাসেবা বন্ধ হয়ে পড়ে।

দেশের গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন এলাকা ও ইউনিয়ন হলেও সেন্ট মার্টিনে স্বাস্থ্যসেবা নেই। কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা অত্যাধুনিক ভবনের বেশির ভাগ কক্ষ ফাঁকা পড়ে আছে। ২০ শয্যার হাসপাতাল শুধু কাগজে-কলমে, বাস্তবে তার কিছুই নেই।
হাবিব উল্লাহ খান, সাবেক সদস্য, সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদ

দ্বীপের গলাচিপার বাসিন্দা জামালিদা বেগম বলেন, দ্বীপের বাসিন্দারা চাইলেই জরুরি মুহূর্তে উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে টেকনাফ সদরের হাসপাতাল যেতে পারেন না। তাই প্রসবের সময় অস্ত্রোপচার প্রয়োজন, এমন নারীদের নিয়ে বিশেষ করে ভোগান্তিতে বেশি পড়তে হচ্ছে।

সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য হাবিব উল্লাহ খান প্রথম আলোকে বলেন, দেশের গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন এলাকা ও ইউনিয়ন হলেও সেন্ট মার্টিনে স্বাস্থ্যসেবা নেই। কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা অত্যাধুনিক ভবনের বেশির ভাগ কক্ষ ফাঁকা পড়ে আছে। ২০ শয্যার হাসপাতাল শুধু কাগজে-কলমে, বাস্তবে তার কিছুই নেই।

পর্যটন মৌসুমে কিছুটা চিকিৎসাসেবা পাওয়া গেলেও বর্ষায় হাসপাতালে ভুতুড়ে পরিবেশ থাকে বলে জানান পূর্বপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমদ। তিনি বলেন, উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে সব সময় দ্বীপের বাসিন্দারা টেকনাফ যেতে পারেন না। তাই দ্বীপের হাসপাতালটির অন্তর্বিভাগ চালু করা জরুরি।

হাসপাতালে রোগীদের জন্য শয্যা রয়েছে। তবে অন্তর্বিভাগ বন্ধ থাকায় খালি পড়ে রয়েছে এসব শয্যা। সম্প্রতি তোলা
ছবি: প্রথম আলো

সেন্ট মার্টিন ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, প্রায় ৩৪ কিলোমিটার দূরে টেকনাফ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে চিকিৎসাসেবা নেওয়া দ্বীপের মানুষের পক্ষে এমনিতেই দুরূহ। বর্ষা মৌসুমে অধিকাংশ সময় টেকনাফের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এই দ্বীপ। নৌ অ্যাম্বুলেন্স না থাকায় এ সময়টাতে অনেকটা বিনা চিকিৎসায় থাকতে হয় মানুষকে। নানা চেষ্টা-তদবির করেও হাসপাতালটি চালু করা যাচ্ছে না।

সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ফয়েজুর রহমান বলেন, দ্বীপবাসীর দাবি প্রয়োজনীয় প্যাথলজি পরীক্ষা, অন্তর্বিভাগ সেবাসহ ২০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হোক। সেই সঙ্গে থাকুক সি-অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থাও।

জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা চিকিৎসক প্রণয় রুদ্র প্রথম আলোকে বলেন, ‘এনজিওর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চাকরিচ্যুত হওয়ার পর থেকে হাসপাতালটি শূন্য পড়ে আছে। তারপরও যতটুকু সম্ভব আমরা সেবা দিই। হাসপাতালে নিয়োগের জন্য নানাভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে’। তিনি বলেন, কয়েক মাস ধরে টেকনাফ থেকে একজন চিকিৎসক হাসপাতালটিতে কিছুদিনের জন্য পাঠানো হয়। তিনি মাসে দুইবার বা তিনবার করে গিয়ে রোগী দেখেন। সর্বশেষ গত সপ্তাহে তিনি সেন্ট মার্টিনে রোগী দেখেছেন।