গুজরাট থেকে উড়োজাহাজ-লঞ্চে করে চোখ বেঁধে আনা হয়েছে, জানালেন ভুক্তভোগীরা

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পশ্চিম সুন্দরবনের মান্দারবাড়িয়া চরে বিএসএফের রেখে যাওয়া ৭৮ জনকে শ্যামনগর থানা-পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে কোস্টগার্ড। তাঁদের শ্যামনগর থানার দোতলায় রাখা হয়েছেছবি: প্রথম আলো

সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) ফেলে যাওয়া ৭৮ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁদের অনেকে অসুস্থ, কারও কারও শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন আছে। একজনের হাত ভাঙা। বেশির ভাগই কয়েক দিন না খেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তাঁদের সবাইকে সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানার দোতলার একটি কক্ষে রাখা হয়েছে। কয়েকজন জানিয়েছেন, ১৫ দিন পর এই প্রথম থানায় এসে ভাত খেতে পেরেছেন তাঁরা।

পুলিশ জানিয়েছে, বিএসএফ যে ৭৮ জনকে ফেলে রেখে গেছে, তাঁদের মধ্যে ৭৫ জন বাংলাদেশি এবং ৩ জন ভারতীয় নাগরিক। গত শুক্রবার তাঁদের শ্যামনগর উপজেলার পশ্চিম সুন্দরবনের মান্দারবাড়িয়া চরে ফেলে রেখে যায় বিএসএফ। এরপর বন বিভাগ তাঁদেরকে উদ্ধারের পর শনিবার রাত ১১টার দিকে কোস্টগার্ডের কাছে হস্তান্তর করে। এরপর গতকাল রোববার রাত সাড়ে ১১টার দিকে সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানায় হস্তান্তর করা হয়।

বন বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক মশিউর রহমান বলেন, ক্যাম্প থেকে তাঁকে জানানো হয়েছিল, উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিরা কয়েক দিন না খেয়ে থাকার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজনের হাত ভেঙে গেছে, আরও কয়েকজনের শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন ছিল। স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় খাবার, স্যালাইন ও পানি নিয়ে তিনি সেখানে পৌঁছান।

শ্যামনগর থানার দোতলায় ৭৮ জনকে একসঙ্গে রাখা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে নড়াইল জেলার ৬৩ জন, বাকি ৮ জনের বাড়ি সাতক্ষীরা, যশোর, বরিশাল ও ঢাকা জেলায়। তিনজন ভারতীয় নাগরিকের বাড়ি ভারতের গুজরাট রাজ্যের আহমেদাবাদে।

গত শুক্রবার ভোরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী দেশটিতে অবৈধভাবে থাকা ৭৮ বাংলাদেশিকে কয়েকটি স্পিডবোটে করে এনে সুন্দরবনের গহিনে মান্দারবাড়িয়া এলাকায় নামিয়ে দিয়ে যায়
ছবি: বন বিভাগের সৌজন্যে পাওয়া

গতকাল রাত একটার দিকে থানার দোতলার কক্ষে কথা হয় ভারতে থেকে আসা হারুন শেখের (৬০) সঙ্গে। তাঁর বাড়ি নড়াইলের কালিয়া উপজেলার মাধবপাশা গ্রামে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ৩৭ বছর ধরে ভারতে ভাঙারির ব্যবসা করতেন তিনি। থাকতেন আহমেদাবাদের সুরাট বস্তিতে। মাঝেমধ্যে বাংলাদেশ আসা-যাওয়া করতেন। গত ২৬ এপ্রিল দেশটির ক্রাইম পুলিশ বস্তিতে বসবাসকারী ৫০০-৬০০ জনকে আটক করে। এ সময় তাঁদের সামনে বছরের পর বছর ধরে থেকে আসা বস্তিটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে তাঁদের একটি পুলিশ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিয়ে যাওয়ার পর নারী, পুরুষ ও শিশুদের আলাদাভাবে করে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে। তাঁদের ৭৮ জনকে একটি দলে রাখা হয়। পরে সেখান থেকে চোখ বেঁধে বিভিন্ন স্থানে রাখা হয়। এ সময় তাঁদের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। দুপুরে খেতে দেওয়া হতো একটি রুটি ও পানি। অন্য সময় দুটি করে বিস্কুট। ৬ মে তাঁদের চোখ বেঁধে আহমেদাবাদ থেকে উড়োজাহাজে করে নিয়ে আসা হয় কলকাতায়। সেখান থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকার ভারতের সন্দেহখালীতে। সেখানে দিনে রাখার পর আবার চোখ বেঁধে একটি বড় লঞ্চ তুলে ৯ মে ভোর চারটার দিকে সুন্দরবনের গহিনে তাঁদের নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। পরে সকাল ৯টার দিকে বন বিভাগের সহযোগিতায় সাতক্ষীরা স্টেশনের মান্দারবাড়িয়া ক্যাম্পে আশ্রয় নেন তাঁরা।

নড়াইলের কালিয়া উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের হাসান শেখ আট বছর আগে, একই জেলার লোহাগড়া উপজেলার চান্দেরচর গ্রামের শিহাত হোসেন (৩৫) ১২ বছর আগে ও খুলনার তেরখাদা উপজেলার মোকামপুর এলাকার শাখায়েত মোল্যা (৪০) তিন বছর আগে কাজের সন্ধানে গুজরাটে গিয়েছিলেন। তাঁরাও সুরাট বস্তির বাসিন্দা ছিলেন। তাঁরা জানান, তাঁদের ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী ও মা–বাবাদের সুরাট বস্তি থেকে পুলিশ কোথায় নিয়ে গেছে, সেটি তাঁরা জানেন না। তাঁদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। স্বজনদের সন্ধান চান তাঁরা।

এদিকে কোস্টগার্ডের সদস্যরা ৭৮ জনের মধ্যে ৩ জনকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁরা হলেন আবদুর রহমান (২০), হাসান শাহ (২৪) ও সাইফুল শেখ (১৯)। নড়াইলের কালিয়া উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামে তাঁদের পৈতৃক বাড়ি হলেও তাঁদের জন্ম হয়েছে গুজরাটের ওই বস্তিতে। তাঁদের বিরুদ্ধে শ্যামনগর থানায় অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের অভিযোগে কোস্টগার্ডের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে।

শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ভারতীয় নাগরিকদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বাকি ৭৫ জনকে স্বজনদের খবর দেওয়া হয়েছে। স্বজনেরা এলে তাঁদের হস্তান্তর করা হবে।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন