ভুক্তভোগীদের নিয়ে আদালতে মেয়র, পুলিশ বলছে, তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে না

সকাল থেকেই নারায়ণগঞ্জ আদালত এলাকায় ছিলেন মেয়র হালিম সিকদার। (বা থেকে প্রথমে) আজ বুধবা্র দুপুর আড়াইটায় নারায়ণগঞ্জ আদালত প্রাঙ্গণের বাইরের একটি চায়ের দোকানে
ছবি: প্রথম আলো

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় চুরির অপবাদে তিন শিশুকে গ্রামে ঘোরানোর পর দুই শিশুর চুল কেটে দেওয়ার ঘটনার মামলার প্রধান আসামি গোপালদী পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হালিম সিকদারকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। যদিও মেয়রকে ভুক্তভোগী তিন শিশু ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আজ বুধবার সকাল থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত আদালত প্রাঙ্গণে অবস্থান করতে দেখা গেছে।

তবে আড়াইহাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দুজনকে গ্রেপ্তারের পর গতকাল দিবাগত রাতে ও আজ সকালে মেয়রকে গ্রেপ্তার করতে অভিযান চালিয়েছি। তাঁকে পাওয়া যায়নি।’

ভুক্তভোগী তিন শিশুর পরিবারের সদস্যরা বলছেন, মেয়রের পক্ষ থেকে তাঁদের আদালতে নিয়ে আসা হয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্র ও শিশুদের জন্মনিবন্ধন নিয়ে তাঁরা আদালতে এসেছেন। পরবর্তী করণীয় কী, তা মেয়রই বলে দেবেন।

মামলার বাদী ভুক্তভোগী এক শিশুর বাবা প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ মামলা করতে বলছে, আমি করছি। এখন মেয়র সাহেব যেভাবে বলবেন, সেভাবেই করমু। সবই তো বোঝেন।’

নির্যাতনের শিকার ১১ বছর বয়সী শিশুর বাবা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আর এটা নিয়া আগাইতে চাই না।’

মেয়রের হুমকিতে ভয় পেয়ে তাঁরা মীমাংসার কথা ভাবছেন কি না, জানতে চাইলে বলেন, ‘এটা অসম লড়াই। উনি আমার চাচা মানুষ। যা হওয়ার হইছে।’

এর আগে নির্যাতনের শিকার সাত বছর বয়সী শিশুর বাবা বাদী হয়ে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে আড়াইহাজার থানায় শিশু আইনে একটি মামলা করেন। মামলায় পৌরসভা মেয়রকে প্রধান করে চারজনের নাম উল্লেখসহ মোট নয়জনকে আসামি করা হয়।
এদিকে মামলার পর এ ঘটনায় আটক দুজনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠিয়েছে পুলিশ। গ্রেপ্তার দুজন হলেন মেয়রের বাড়ির বাগানের মালি মো. ফারুক ও ওই এলাকার নাপিত দ্বীপক শীল। তবে মামলার প্রধান আসামি পৌরসভা মেয়র হালিম সিকদারকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ।

হুমকির পর মীমাংসা চান ভুক্তভোগীরা
গতকাল সরেজমিন রামচন্দ্রদী বাজার এলাকায় গেলে ভুক্তভোগীর পরিবার ও স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ হালিম সিকদারের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে কথা বলতে রাজি হননি।

সরেজমিনে ঘুরে জানা যায়, গত সোমবারের ঘটনা গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে প্রকাশ করার বিষয়টি হালিম সিকদার ভালোভাবে নেননি। সোমবার সন্ধ্যায় তিনি দলবল নিয়ে নির্যাতনের শিকার ১১ বছর বয়সী মাদ্রাসাছাত্রের বাড়িতে যান। এ সময় ওই শিশুসহ পরিবারের লোকজনের বিরুদ্ধে চুরির মামলা করার হুমকি দেন মেয়র। পরে তাৎক্ষণিকভাবে শিশুর মা ও স্বজনেরা কান্নাকাটি করে মেয়রের কাছে ক্ষমা চান। পরে ১১ বছরের ওই শিশু জনসমক্ষেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে মেয়রের পা ধরে ক্ষমা চায়। পরে মেয়রের এমন হুমকির পর সেই শিশুর পরিবার রাতেই বাড়ি ছেড়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন।

গতকাল দুপুরে ওই শিশুর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছোট্ট চৌচালা টিনের ঘরটি বাইরে থেকে তালা দেওয়া। সেখানেই কথা হয়, শিশুটির চাচির সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমরা ওনার (মেয়রের) এখানে কাজ কইরা খাই। ছেলে আমাদের, মেয়রও আমাদের। এখন মীমাংসা করলেই আমাদের জন্য ভালো।’

১১ বছর বয়সী শিশুটির ঘর লাগোয়া টিনের খুপরিতেই আরেক ভুক্তভোগী ৮ বছর বয়সী শিশুর বসবাস। ওই শিশুর ঘরে গিয়েও ঘরটি বাইরে থেকে তালাবদ্ধ পাওয়া যায়।

নাম না প্রকাশের শর্তে স্থানীয় এক তরুণ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিটি শিশুর পরিবার নিম্ন আয়ের। সোমবার বিকেল থেইকা মেয়রের লোকজন বারবার হুমকি দিয়া যাইতাছে। জলে বাস কইরা কুমিরের লগে যুদ্ধ করা উচিত না। মীমাংসা না করলে ওরা এলাকায়ও থাকতে পারব না।’

গতকাল বিকেলে উপজেলা পরিষদে গেলে ১১ বছরের শিশুসহ ৩ ভুক্তভোগী শিশুর সঙ্গেই দেখা হয়। সোমবার ১১ ও ৮ বছর বয়সী শিশুর চুল কেটে দেওয়ার পর তাদের দুজনের মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয়েছে। এ সময় ১১ বছরের ওই শিশুর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় পাওয়ার পর শুরুতে এই শিশু কথা বলতে রাজি না হলেও পরে অভয় পেয়ে ঘটনার বিস্তারিত জানায়। এই শিশু বলে, ‘আজকা (মঙ্গলবার) সকালে আমারে ধইরা আনার পর দুপুর পর্যন্ত পৌরসভায় আটকাইয়া রাখে। পরে মেয়র সাহেবের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। উনি (মেয়র) বলছেন, কাইলকার (সোমবারের) ঘটনা যেন পুলিশ, সাংবাদিক আর সরকারি অফিসারগো না কই। কইলে আমাগো ঘরবাড়ি ভাইঙ্গা নদীতে ফালাইয়া দিব।’

শিশুটির বাবা প্রথম আলোকে বলেন, সোমবার মেয়রের হুমকির পর মায়ের সঙ্গে শিশুটি নানাবাড়িতে পালিয়ে গিয়েছিল। সকালে মেয়রের নির্দেশে তাঁর ছোট ভাই (শিশুর চাচা) নানা বাড়ি থেকে তাঁকে পৌরসভায় নিয়ে আসে। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর পর্যন্ত তাঁদের গোপালদী পৌরসভা ভবনে আটকে রেখে পরে মেয়রের লোকজন তাঁদের আড়াইহাজার উপজেলা পরিষদে নিয়ে যান। সেখানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে আসা তদন্ত দলের সঙ্গে কথা বলার আগপর্যন্ত তাঁর ছেলে মেয়রের কাছেই ছিল।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে হালিম সিকদার বলেন, ‘সব বানোয়াট। ওরা এমনটা কেন বলছে, তা বলতে পারছি না।’

জেলা প্রশাসকের তদন্ত দল
গতকাল জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ঘটনার তদন্ত করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মো. আনোয়ার হোসাইন ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইশতিয়াক আহমেদ গতকাল বেলা ১১টার পর ঘটনার সরেজমিন তদন্ত করেন। বিকেলে উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ে ঘটনার ভুক্তভোগী ও অভিযুক্ত ব্যক্তিরা তদন্ত দলের কাছে ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরেন। তদন্তের আগে ভুক্তভোগীদের সবাইকেই মেয়রের স্বজন ও অনুসারীরা ঘিরে রেখেছিলেন।

তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মো. আনোয়ার হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভুক্তভোগী ও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলেছি। আমরা মন্ত্রণালয়ে জানাব।’

ওই মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ আদালতের পুলিশ পরিদর্শক আসাদুজ্জামান বলেন, ওই মামলায় আজ কোনো শুনানি হয়নি।