আবাদ বেড়েছে, দামে হতাশ পাটচাষিরা

মানিকগঞ্জে এবার গত বছরের তুলনায় বেশি পাট আবাদ হয়েছে। কিন্তু দাম তুলনামূলক কম থাকায় হতাশ কৃষকেরা। গতকাল দুপুরে ঘিওর উপজেলা সদরে ঘিওরে পাটের হাটে
ছবি: প্রথম আলো

মানিকগঞ্জে এবার পাটের আবাদ বাড়লেও কৃষকের মনে উচ্ছ্বাস নেই। কেননা, এ বছর প্রতি মণ পাটের দাম কমেছে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা। পাট বিক্রি করে উৎপাদন খরচ মিটিয়ে লাভ পাচ্ছেন না কৃষকেরা। পাটের দাম নিয়ে তাঁদের মধ্যে দেখা দিয়েছে ক্ষোভ ও হতাশা।

কয়েকজন পাটচাষি ও ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ ঘোষণা করায় স্থানীয় অনেক ব্যবসায়ীই এবার পাট কিনছেন না। এতে বাজারে পাটের দাম কমে গেছে। বাজারে বর্তমানে প্রতি মণ পাট ১ হাজার ৯০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এই দামে পাট বিক্রি করে চাষিদের কোনোরকমে উৎপাদন খরচ উঠছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলার সাতটি উপজেলায় পাটের আবাদ হয়ে থাকে। গত বছর জেলায় ৩ হাজার ৯৭৩ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছিল। এতে উৎপাদন হয়েছিল ১০ হাজার ৬৩ মেট্রিক টন পাট। এ বছর তা বেড়ে ৪ হাজার ৬৫৬ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। পাট উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৭৫৭ মেট্রিক টন। গতবার ভালো দাম পাওয়ায় এবার বেশি জমিতে পাটের আবাদ করেছিলেন কৃষকেরা।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এবার প্রতি বিঘা জমিতে হালচাষ ও বীজ বপণ থেকে শুরু করে সার-কীটনাশকের খরচ, পানি সেচ, শ্রমিক খরচ, জাগ দেওয়া, আঁশ ছড়ানো শেষে শুকিয়ে ঘরে তোলা পর্যন্ত খরচ পড়েছে ১৩ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। প্রতি বিঘায় ৭ থেকে ৮ মণ ফলন পাওয়া যায়। পাটবীজ, কীটনাশক সবকিছুরই দাম বেড়েছে। এবার শ্রমিকের মজুরি ব্যাপক বেড়ে গেছে। ফলে পাট চাষে খরচ বেশি বেড়েছে।

দেশের অন্যতম পাটের মোকাম হলো ঘিওর পাটের হাট। সপ্তাহের বুধবার এখানে হাট বসে। ওই হাটে গতকাল সরেজমিন দেখা গেছে, ছোট–বড় বিভিন্ন যানবাহনে করে চাষিরা হাটে পাট নিয়ে আসছেন। এ ছাড়া নদীপথেও পাট নিয়ে আসছেন অনেকে। হাটে আসার পর দরদাম কষে ব্যবসায়ীদের কাছে পাট বিক্রি করছেন চাষিরা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গতকাল হাটে প্রায় তিন হাজার মণ পাট কেনাবেচা হয়েছে। দাম কম থাকায় কৃষকেরা হাটে পাট কম আনছেন। হাটের ইজারাদার শামসুল আলম খান বলেন, মানভেদে প্রতি মণ পাট ১ হাজার ৯০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকায় পাট কেনাবেচা হয়েছে।

তিন মণ তোশা পাট নিয়ে হাটে আসেন জেলার দৌলতপুর উপজেলার ধামশ্বর গ্রামের সপু মিয়া (৬৫)। প্রতি মণ পাট ১ হাজার ৯০০ টাকায় বিক্রি করেন তিনি। এই দামে পাট বিক্রি করে হতাশা প্রকাশ করে এই পাটচাষি বলেন, ‘হালচাষ থেকে শুরু করে হাটে পাট নিয়ে আসতে যা খরচ হচ্ছে, তাতে লাভ হচ্ছে না। টেনেটুনে চালান (উৎপাদন খরচ) উঠছে। এর থেকে ভুট্টার আবাদ করলেও ভালো আছিল।’

দৌলতপুরের খলসি গ্রামের পাটচাষি আবদুল মালেক বলেন, ‘কামলার (শ্রমিক) সাথে পরিবারের মানুষজন মিল্যা আমরা হাড়ভাঙা খাটুনির কাজ করি। কিন্তু সেই খাটুনির কোনো দাম পাওয়া গেল না। প্রতি মণ পাটের দাম আড়াই হাজার টাকা পাওয়া গেলে আমরা কিছুটা হইলেও লাভ পাইতাম।’

জামালপুর সদরের পিয়ারপুর গ্রাম থেকে এই হাটে পাট কিনতে আসেন বাদল দাস (৫০)। তিনি বলেন, চার বছর ধরে এই হাটে পাট কিনে কুমিল্লার চান্দিনায় বেসরকারি পাটকল জনতা জুট মিলে বিক্রি করে আসছেন। ভরা মৌসুমে এবার হাটে পাট কম উঠেছে। গত বছর এই সময়ে ২ হাজার ৩০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকা দরে প্রতি মণ পাট কিনলেও এবার কিনছেন ২ হাজার টাকা দরে।

হাটের ইজারাদারের লোকজন, কয়েকজন কৃষক ও পাট ব্যবসায়ী বলেন, সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ ঘোষণা করার পাশাপাশি পাটের চাহিদাও কমে গেছে। ফলে স্থানীয় পাট ব্যবসায়ীরা পাট কিনছেন না। বেসরকারি পাটকলগুলোর জন্য দূরের পাট ব্যবসায়ীরা হাটে এসে পাট কিনছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দাবি, পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাড়লে চাহিদা ও দাম বাড়বে। এতে চাষিরা লাভবান হবেন। আরও বেশি পাট আবাদ করবেন।

পাটের দামের বিষয়টি সাময়িক বলে মন্তব্য করেছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবু মো. এনায়েত উল্লাহ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ভরা মৌসুমের সময় যেকোনো শস্য বা পাটের দাম কম থাকে; পরে বেড়ে যায়। সরকারি পাটকলগুলো চালুর কোনো সিদ্ধান্ত নেই বলেও জানান এনায়েত।