শীতেও সবজির দামে উত্তাপ খুলনার বাজারে

নগরের বাজারগুলোতে ৫০ টাকার নিচে তেমন কোনো সবজি নেই। চাল, পেঁয়াজ ও রসুনের দামও বাড়তি। 

খুলনা নগরের চানমারী এলাকায় বসবাস জানা বেগমের। চারজনের সংসারে ছেলে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। সব মিলিয়ে নির্মাণশ্রমিক ছেলের মাসিক আয় ১৫ হাজার টাকার মতো। এই আয়ের মধ্যে বাসাভাড়া, খাওয়া, ওষুধপাতি কেনাসহ সব খরচ চালাতে হয়। 

গতকাল সোমবার দুপুরে নগরের টুটপাড়া জোড়াকল বাজারে সবজির দোকানে কেনাকাটা করার সময় জানা বেগম বলেন, মাসিক খরচ চালানো ভীষণ কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁদের জন্য। মাছ-মাংস দূরে থাক, চাল-সবজি কিনতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। এই শীতেও সবজির দাম চড়া। 

শুধু জানা বেগম নন, নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতার কারণে খুলনার সীমিত আয়ের পরিবারগুলোর হিমশিম অবস্থা। বাজারে আসা লোকজন বলেন, শীতকাল মানে সবজির সময়। এখন বাজার ভরা সবজি। তারপরও ৫০ টাকার নিচে কোনো সবজি নেই। জিনিসপত্রের দাম শুধু বাড়ছেই। 

গত রবি ও গতকাল সোমবার খুলনার ময়লাপোতা সন্ধ্যাবাজার, মিস্ত্রিপাড়া কাঁচাবাজার, শেখপাড়া ও টুটপাড়া জোড়াকল বাজার ঘুরে ক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা বেড়েছে। আলুর দাম গত সপ্তাহের মতোই ৫০ টাকা (কেজি) আছে। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে চালের দাম প্রতি কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা করে বেড়েছে। আর শীতের সবজির দাম কমেনি। গাজর ও মুলা বাদে কোনো সবজির দামই কেজিতে ৫০ টাকার কম নয়। 

গতকাল কাঁচা মরিচ বিক্রি হয়েছে ৮০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে। আলুর কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা। প্রতি কেজি বেগুনের দাম ৬০ থেকে ৮০ টাকা। ক্ষীরা বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা দরে। উচ্ছে প্রতি কেজি ৮০-১০০ টাকা, টমেটো ৫০-৬০ টাকা, শিমের কেজি ৬০-৮০ টাকা। ওলকপি, ফুলকপি, পেঁয়াজের ফুল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫০ টাকা করে। ৪০ টাকার মধ্যে আছে মাত্র তিনটি সবজি—মুলা, বাঁধাকপি ও গাজর। 

মিস্ত্রিপাড়া বাজারে ২৮ বছর ধরে সবজির ব্যবসা করেন হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘দাম বাড়েনি, এ রকম কোনো জিনিসই তো নেই। তবে আমার ব্যবসায়ী জীবনে কখনোই ভরা মৌসুমে সবজির এ রকম চড়া দাম থাকতে দেখিনি। দাম বেশি থাকায় ক্রেতাদের কাছে নানা রকম জবাবদিহি করতে হচ্ছে।’ 

খুলনার বাজারে দেশি পেঁয়াজ গত সপ্তাহে প্রতি কেজি ৭৫-৮০ টাকায় পাওয়া গেলেও সোমবার ৯৫ থেকে ১০০ টাকা করে বিক্রি হয়েছে। দেশি রসুনের দাম ২৫০ থেকে বেড়ে ৩২০ টাকা কেজি হয়েছে। 

মিস্ত্রিপাড়া বাজারের আলু-পেঁয়াজ বিক্রেতা মো. মাসুম শেখ বলেন, আড়ত থেকে আলু কিনতেই হচ্ছে অনেক বেশি দামে। আবার বস্তা থেকে অনেক আলু বাদ যায়। বাছাই করা আলু ৫০ টাকার কম বিক্রি করলে পকেটে কিছু থাকে না। আর গত সপ্তাহের চেয়ে এ সপ্তাহে পেঁয়াজে কেজিতে প্রায় ১৫-২০ টাকা বেড়েছে। পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের আমদানি কম। বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজ নেই। 

গত রোববার বিকেলে দোলখোলা এলাকায় ভ্রাম্যমাণ সবজির দোকানে কেনাকাটা করার সময় গৃহিণী নাজনীন আক্তার বলেন, ‘বাজারে ঢুকতেই এখন ভয় লাগে। কোনো কিছুর দাম কমে না। শীতের এই ভরা মৌসুমে ফুলকপি, টমেটো ৫০-৬০ টাকা কেজি কিনতে হচ্ছে। আর আলু-পেঁয়াজ কিনলে ২০০ টাকার মতো শেষ।’ 

এদিকে প্রায় দেড় সপ্তাহ ধরে খুলনার বাজারে সব রকমের চালের দাম বেড়েছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর খুলনার উপপরিচালকের কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১১ জানুয়ারি খুলনার বাজারে মোটা চাল ৫০ থেকে ৫২ টাকায়, মাঝারি চাল ৫৮ থেকে ৬০ টাকায় এবং সরু চাল ৬৪ থেকে ৬৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে। রোববার সন্ধ্যাবাজারে মোটা স্বর্ণা চাল ৫৫ টাকা, আটাশ চাল ৬০ টাকা, মিনিকেট চাল ৭০ টাকা এবং বাসমতী চাল প্রতি কেজি ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। 

খুলনায় মাছের বাজারেও স্বস্তি নেই। বাজারে এক কেজির পাঙাশ মাছ ১৮০ টাকা এবং মাঝারি আকারের তেলাপিয়া ১৫০-১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চাষের রুই ২৮০ থেকে ৩২০ টাকা কেজি। মিস্ত্রিপাড়া ও জোড়কল বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সোনালি ও কক মুরগির দাম একটু বেশি, প্রতি কেজি ২৬০ থেকে ২৮০ টাকা। 

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর খুলনার সহকারী পরিচালক মো. ওয়ালিদ বিন হাবিব বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে খুলনার খুচরা বাজারে অভিযান একটু কম হচ্ছে। আবারও পুরোদমে অভিযান শুরু হবে। 

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) খুলনা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক এম নাজমুল আযম বলেন, দাম বাড়ছে, বাড়বে—এটাই যেন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। সরকারের বিভিন্ন ধরনের অভিযান উদ্যোগেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। কারণ, যে সমন্বিত উদ্যোগ দরকার, সেটা হচ্ছে না। তেমন কোনো সামাজিক উদ্যোগও সৃষ্টি করা যাচ্ছে না।