উন্নয়নকাজের দর ঠিকাদারদের কাছে আগেই ফাঁস হয়েছে, তাই অনিয়ম রোধে প্রায় ১০০ কোটি টাকার উন্নয়নকাজের কার্যাদেশ দিতে আপত্তি জানান চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। তিনি দরপত্র বাতিলের সুপারিশ করেন। ঠিকাদার নিয়োগের প্রক্রিয়া আটকে যাওয়ায় সংস্কারসহ বিভিন্ন উন্নয়নকাজ থমকে আছে।
সিটি করপোরেশনের মেয়র শাহাদাত হোসেন ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামের মধ্যে চলমান বিরোধের কারণ খুঁজতে গিয়ে শতকোটি টাকার উন্নয়নকাজের দরপত্র বাতিল করে দেওয়ার বিষয়টি সামনে এসেছে। মেয়র ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার বিরোধ সম্পর্কে জানেন, এমন তিন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে এই তথ্য জানান।
দুই শীর্ষ কর্তার সম্পর্কের অবনতির পেছনে আরও দুটি কারণ রয়েছে বলে জানান এই তিন কর্মকর্তা। এগুলো হচ্ছে দুটি প্রতিষ্ঠানের গৃহকর জালিয়াতির তদন্তে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার অবহেলা, ডিপ্লোমাধারী এক প্রকৌশলীকে আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে পরিচালক নিয়োগ এবং ডিগ্রি না থাকা সত্ত্বেও তাঁকে বিদ্যুৎ ও যান্ত্রিক শাখার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার আপত্তি। এই তিন কর্মকর্তার মতে, দরপত্র বাতিল করে দেওয়ায় সিটি করপোরেশনের মেয়র শাহাদাত হোসেনের ধারণা জন্মে, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উন্নয়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করছেন।
মেয়র শাহাদাত হোসেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে সরিয়ে নিতে ২ নভেম্বর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে দেওয়া চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা চট্টগ্রামের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে দরপত্র ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক নথিপত্র সই না করে দীর্ঘদিন ধরে তাঁর দপ্তরে আটকে রাখেন। উন্নয়নকাজের তদারকি ও সমস্যা নিরসনে তাঁকে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
তবে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দাবি, দরপত্র যাচাইয়ের সময় দেখা যায়, কিছু ঠিকাদার অতি গোপনীয় দর যেকোনোভাবে জেনে যান এবং সেভাবেই দরপত্র দাখিল করেন। তাই অনিয়ম রোধে দরপত্র বাতিল করে পুনঃ দরপত্র দেওয়ার ও তথ্য ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু পুনঃ দরপত্র বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও কারও বিরুদ্ধে কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা প্রশ্রয় পেয়েছেন।
বর্তমান পরিস্থিতিতে শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামকে সিটি করপোরেশন থেকে সরিয়ে নিতে ২ নভেম্বর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন মেয়র। আবার উচ্চতর প্রশিক্ষণ শেষে মেয়র তাঁকে সিটি করপোরেশনে যোগদান করতে দেননি, তা চিঠি দিয়ে মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। এসব বিষয় নিয়ে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে মন্ত্রণালয়।
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উচ্চতর প্রশিক্ষণ শেষে কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার জন্য গত ২২ অক্টোবর পত্র দিলেও তা গ্রহণ করেননি মেয়র। উল্টো গৃহকর জালিয়াতির তদন্তে অবহেলার জন্য কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন। তাঁকে অপসারণের দাবিতে মিছিল-সমাবেশ করেছেন জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল-সমর্থিত শ্রমিক-কর্মচারীরা।
গত বছরের ১ অক্টোবর শাহাদাত হোসেনকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে জয়ী ঘোষণা করেন আদালত। ৩ নভেম্বর শপথ নেওয়ার পর ৫ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়রের দায়িত্ব নেন তিনি। সিটি করপোরেশনের মতো সেবা সংস্থায় দুই শীর্ষ কর্তার বিরোধে নগরবাসী দুর্ভোগে পড়বেন বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সরকার গবেষকেরা। তাই দ্রুত এই পরিস্থিতি অবসানের তাগিদ দিয়েছেন।
তদন্তে অবহেলা, পদোন্নতিতে আপত্তি
সিটি করপোরেশনের সূত্র জানায়, সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলী জসীম উদ্দিনকে আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক করা হয়। পুরকৌশল শাখার এই প্রকৌশলীকে যান্ত্রিক ও বিদ্যুৎ শাখার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী করা হয়। এভাবে বিধিবহির্ভূতভাবে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ ও একাধিক দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সায় ছিল না।
দায়িত্ব বণ্টনের অফিস আদেশে সচরাচর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সচিব সই করলেও এ ক্ষেত্রে মেয়র নিজেই সই করেন। পরে বিতর্ক সৃষ্টি হলে যান্ত্রিক ও বিদ্যুৎ শাখার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
মেয়র শাহাদাত হোসেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার ওপর সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ হয়েছেন দুই প্রতিষ্ঠানের গৃহকর নির্ধারণে জালিয়াতির বিষয়ে তদন্তে অবহেলার কারণে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে নগরের দুটি প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক গৃহকর মূল্যায়ন ৫১ কোটি টাকা হলেও ঘষামাজা করে ৪০ কোটি টাকা কমানো হয়।
মেয়র শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গৃহকর নির্ধারণে ঘষামাজার বিষয়টি ধরা পড়ে ২০২৩ সালে, তখনো প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। এ নিয়ে তখন একটি কমিটি গঠন করা হলেও প্রতিবেদন দিতে পারেনি। পরে তিনি (মেয়র) দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুনভাবে তদন্ত কমিটি গঠন করেন। শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম ছুটিতে গেলে সচিবকে ভারপ্রাপ্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন তদন্তের কাজ শেষ হয়েছে।
মেয়র শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘এই তদন্ত প্রতিবেদন দিতে গিয়ে যাঁরা গাফিলতি করেছেন, আমি মনে করছি, তাঁরা কোনো না কোনোভাবে সেটিতে সম্পৃক্ত থাকবেন। এ জন্য আমি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছি।’
তবে কোনো ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসন কার্যক্রম, অস্থায়ী শ্রমিকদের স্থায়ীকরণ, বেহাত হয়ে যাওয়া প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় পুনরুদ্ধার করাসহ যাবতীয় কাজ সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে করেছেন। গৃহকর জালিয়াতির তদন্তের জন্য যোগ্য ও দক্ষ কর্মকর্তাকে দিয়ে কমিটি গঠন করে দিয়েছিলেন। এখন তাঁর বদলির বিষয়ে মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত দেবে, তা পালন করবেন।
এ ছাড়া নগরের দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডে বর্জ্যাগারের জন্য ৪০ একর জায়গা কেনা, নগরের ফুটপাত, সড়ক বিভাজকসহ সিটি করপোরেশনের খালি জায়গা সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ইজারা ও বিপ্লব উদ্যানের ইজারা দেওয়া নিয়ে মেয়রের উদ্যোগের সঙ্গে ভিন্নমত ছিল প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার।
স্থানীয় সরকার গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, সিটি করপোরেশনের মেয়র রাজনীতিবিদ ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। তাঁদের দ্বন্দ্ব একটি নগরের জন্য কোনোভাবেই সুখকর নয়। যদি দুজনের মধ্যে বনিবনা না হয়, তাহলে সিটি করপোরেশনের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। সংস্থার কার্যক্রমেও স্থবিরতা নেমে আসবে। শেষ পর্যন্ত নগরবাসীকে দুর্ভোগ পোহাতে হবে। তাই এর অবসান হওয়া উচিত।