বাড়ছে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু 

পানিতে ডুবে বেশির ভাগ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে পরিবারের সদস্যদের অগোচরে সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে।

পটুয়াখালীতে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু ক্রমেই বাড়ছে। সদ্য সমাপ্ত বছরে জেলায় ৯৬টি শিশু পানিতে ডুবে মারা গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিশুর মৃত্যু হয়েছে কলাপাড়া উপজেলায়। সেখানে গত বছর ২৬টি শিশু পানিতে ডুবে মারা গেছে।

পটুয়াখালী সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০২২ সালে জেলায় পানিতে ডুবে মারা যায় ৯৬টি শিশু। এর মধ্যে দশমিনায় ২৪টি, কলাপাড়ায় ২৬, বাউফলে ১৭, দুমকিতে ১৩, মির্জাগঞ্জে ১ ও গলাচিপায় ১৫টি শিশু রয়েছে। এ সময় পানিতে ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়েও বেঁচে যায় ২৩১ শিশু।

পুকুরের চারদিকে নেট দিয়ে বেড়া দেওয়া ও বাড়ির পাশে অপ্রয়োজনীয় ডোবা মাটি ফেলে ভরাট করে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
এস এম কবির হোসেন, সিভিল সার্জন, পটুয়াখালী

গত বছর ২৯ আগস্ট রাত ৯টার দিকে বাউফল পৌরসভার কাউন্সিলর আজিজুর রহমানের দুই সন্তান পানিতে ডুবে মারা যান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নাজিরপুর বাংলাবাজার এলাকায় ঘরের পাশে নিজ মুদিদোকানে ছিলেন তিনি। স্ত্রী ছিলেন ঘরে। দুই ছেলে ঘরের সামনে খেলছিল। হঠাৎ দেখেন তারা নেই। দৌড়ে গিয়ে খুঁজতে থাকেন। পরে বাড়ির পাশের খাল থেকে দুজনকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। চিকিৎসক শিশু দুটিকে মৃত ঘোষণা করেন। শুধু অসাবধানতার কারণে সন্তানদের হারাতে হলো। 

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর এই সংখ্যা সরকারিভাবে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে। তবে অনেক সময় পানিতে ডুবে মৃত্যুর সব ঘটনার তথ্য সংশ্লিষ্ট অফিস পায় না। তাই জেলায় পানিতে ডুবে প্রকৃত শিশুমৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি।

তবে তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পানিতে ডুবে বেশির ভাগ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে পরিবারের সদস্যদের অগোচরে সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে। বেশির ভাগ শিশুর বয়স ছয় বছরের নিচে। 

গত বছর ১৫ জানুয়ারি দশমিনা সদর ইউনিয়নের পশ্চিম লক্ষ্মীপুর গ্রামে দুই বছরের একটি শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। শিশুটির বাবা বিমল মাঝি বলেন, ঘরের সামনে উঠানে শিশুদের সঙ্গে খেলছিল তাঁর ছেলে নিলয়। পরে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রায় এক ঘণ্টা পর বাড়ির পাশে পুকুর থেকে তার ভাসমান মরদেহ উদ্ধার করা হয়। বিমল মাঝি বলেন, ‘বাড়ির পাশের পুকুরের চারপাশ খোলা ছিল। পুকুরটা জাল দিয়ে আটকানো থাকলে আমার সন্তান এভাবে পানিতে ডুবে মারা যেত না।’

এর আগে ২০২১ সালে পানিতে ডুবে ৫৬টি শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় দশমিনায়। এই উপজেলায় ১৮ শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। এ ছাড়া কলাপাড়ায় ১০, বাউফলে ৯, দুমকিতে ৮, গলাচিপায় ৮, মির্জাগঞ্জে ৩ শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। এ সময় পানিতে ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়েও বেঁচে যায় ৭২ শিশু।

আর ২০২০ সালে জেলার পানিতে ডুবে মারা যায় ২৯টি শিশু। এর মধ্যে দশমিনায় ৯টি, কলাপাড়ায় ৮, বাউফলে ৪, দুমকিতে ৩, মির্জাগঞ্জে ৩ ও গলাচিপায় ২টি শিশু রয়েছে। এ সময় পানিতে ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়েও বেঁচে যায় ৯৬ শিশু। 

শিশুমৃত্যু রোধে কলাপাড়া উপজেলায় কাজ করে বেসরকারি সংগঠন সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ নামের একটি সংস্থা। সংস্থার মাঠদলের ব্যবস্থাপক মোতাহের হোসাইন বলেন, কলাপাড়ায় ৬-১০ বছর বয়সী শিশুদের সাঁতার শেখানো হচ্ছে। এ ছাড়া আঁচলে (শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র) নির্দিষ্ট সময়ে শিশুদের নিরাপদে রাখা ও প্রাথমিক শিক্ষা প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। এক বছর ধরে কাজ করছেন। এর মধ্যে ২ হাজার ৫০০ শিশুকে সাঁতার শেখানো হয়েছে। বর্তমানে ৩১৫টি কার্যক্রম চলছে আঁচলে। সকাল নয়টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত যখন মায়েরা বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকেন, তখন শিশুদের পানিতে ডুবে যাওয়া থেকে নিরাপদে রাখতে মায়েরা সন্তানদের আঁচলে রাখছেন। এখানে শিশুরা নিরাপদের পাশাপাশি শারীরিক বুদ্ধি বিকাশের কার্যক্রমও চালানো হয়।

মোতাহের হোসাইন আরও বলেন, দেশে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ৬০ শতাংশ ঘটে সকাল নয়টা থেকে বেলা একটার মধ্যে। তাই এ সময়ে শিশুকে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা গেলে শিশুমৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে।

পটুয়াখালীর সিভিল সার্জন এস এম কবির হোসেন বলেন, পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে সচেতনতা বাড়াতে প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে। বিশেষ করে পুকুরের চারদিকে নেট দিয়ে বেড়া দেওয়া ও বাড়ির পাশে অপ্রয়োজনীয় ডোবা মাটি ফেলে ভরাট করে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া নির্দিষ্ট বয়সের পর শিশুদের সাঁতার শেখানোর বিষয়টিকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে হবে।