এখনো কুপিবাতির আলোয় জমজমাট শতবর্ষী মিরতিংগার হাট

কুপিবাতি জ্বালিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে মাছসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মিরতিংগা হাটেছবি: প্রথম আলো

সন্ধ্যা নামতেই যেন ‘আবার আকাশে অন্ধকার ঘন হয়ে উঠছে’। ‘আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মতো এই অন্ধকার’—আরও রহস্যময় করে তুলেছে মিরতিংগার হাটকে। চা-বাগানের ভেতর একটুকরা পণ্যের হাট। কালের যাত্রা থেকে বহুদূর ছিন্ন পালকের মতো পড়ে থাকা একদল শ্রমজীবী মানুষের হাট এটি। ‘সমস্ত দিনের শেষে’ ক্লান্তি নিয়ে এই মানুষেরা এখানে আসেন। তাঁদের অর্থবিত্ত কম, চাওয়া-পাওয়ার তালিকাটাও ছোট। হাটের পণ্যে সেই অল্প চাওয়ার চিহ্ন লেগে আছে।

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার একটি চা-বাগান মিরতিংগা। মিরতিংগা চা-বাগানে পুরোনো সময়ের গন্ধমাখা এই হাটের বয়স এখন কত, তা নিশ্চিত করতে পারেন না কেউ। তবে তা যে শত বছরের কাছাকাছি হবে, এ নিয়ে কারও দ্বিধা নেই।
স্থানীয় লোকজন জানান, হাটটি আগে মিরতিংগা চা-বাগানেরই অন্য একটি স্থানে বসত। পরে কোনো একসময় বর্তমান স্থানটিতে হাট বসছে। চা-শ্রমিক, তাঁদের পরিবারের লোকজনই এ হাটের প্রধান ক্রেতা। তবে বেশির ভাগ ব্যবসায়ীই আসেন আশপাশের এলাকা থেকে। এই হাটের সঙ্গে অনেক ব্যবসায়ীর নাড়ির সম্পর্ক। কারও বাপ-দাদা এই হাটে পণ্য নিয়ে আসতেন। কারও হাটে নিয়মিত আসার বয়স হয়ে গেছে ২৫-৩০ বছর। চা-শ্রমিকদের সঙ্গে তাঁদের লেনদেনের এক অলিখিত নগদ-বাকির রোজনামচা আছে, এটা দুই পক্ষই মেনে চলে।

সপ্তাহে দুই দিন বসে মিরতিংগা বাজার—সোম ও বৃহস্পতিবার। বিকেল তিনটার পর থেকে একটু একটু করে হাটটি জমতে শুরু করে। সন্ধ্যায় একদম জমজমাট। সন্ধ্যার পর শ্রমক্লান্ত মানুষের থাকে ঘর ফেরার তাড়া। হাটটি ফাঁকা হতে থাকে। রাত নয়টার দিকে হাট ভেঙে যায়। এর মধ্যে সোমবারের হাটটি অতটা জমে না। এদিন চা-শ্রমিকদের হাতে টাকা থাকে না। যাঁরা ওই দিন (সোমবার) বাজারে আসেন, তাঁদের অনেকেই বাকিতে পণ্য কেনেন। কেউ মজা করে বলেন, সোমবার হচ্ছে বাকির হাটবার। বৃহস্পতিবারেই বাজারটি ভালো জমে। এদিন ‘তলববার’, শ্রমিকেরা সপ্তাহের মজুরি পান। অনেকের হাতে হাজারখানেকের মতো টাকা আসে। তা দিয়েই বাকির টাকা পরিশোধ করেন, সম্ভব হলে মাছ কেনেন। নয়তো চাল, আনাজ-তরকারি, তেল-নুন, যা না কিনলেই নয়। সেগুলো নিয়ে ঘরে ফেরেন। এই একটা নিয়মে সেই কবেকার সময় থেকে মিরতিংগা বাজার চলছে।

সন্ধ্যা নামতে নামতেই জমে ওঠে হাট। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মিরতিংগা হাটে
ছবি: প্রথম আলো

গত বৃহস্পতিবার বিকেলের দিকে মিরতিংগা বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, বাগানের বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন বয়সের চা-শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের লোকজন হাটে আসছেন। তাঁরা বাগানের কাজ সেরে তলব (মজুরি) পেয়েছেন। বিক্রেতারা এরও আগে হাটে এসে নিজেদের নির্ধারিত স্থানে আসন নিয়েছেন। হাটটিতে আধুনিকতা বলতে যে ধারণা আছে, তা এখনো লাগেনি। সারিবদ্ধ সব কটি দোকানই দোচালা টিনের ছাউনি দেওয়া। কোনোটিতেই বেড়া নেই। দোকানের চারদিক খোলা। এই সারির বাইরে টেবিল পেতে, পলিথিন পেতে বসেছেন অনেকে। হাটজুড়ে পুরোনো সময়ের ঘ্রাণ, পুরোনো চেহারা লেগে আছে। কয়েকটি গলিতে ভাগ হয়ে আছে হাটটি। সেসব গলি ধরে চা-বাগানের লোকজন হাঁটছেন, যাঁর যা প্রয়োজন সেই দোকানের সামনে থামছেন। জিনিসপত্রে দরদাম করছেন। দরদামে পোষালে ব্যাগে পুরে নিচ্ছেন। এসব মানুষের তামাটে চেহারাগুলোতে মনে হতে পারে, শত বছরের ক্লান্তি কাদার মতো লেগে আছে। তবু তাঁরা হেসেখেলেই কেনাকাটা সারছেন।

বাজারটিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যেরই জোগান আছে। মাছ, চাল-ডাল, তেল-নুন, শাকসবজি, পেঁয়াজ-রসুন, আদা, বাখর থেকে শুরু করে সব ধরনের মসলাপাতি। আছে জুতা, দা-খুন্তিসহ সংসারের প্রয়োজনীয় আরও অনেক কিছু। বিভিন্ন ধরনের বনজ ও ফলদ গাছের চারা নিয়ে এসেছেন কয়েকজন। বাজারে চাষের ছোট আকারের মাছই বেশি দেখা গেছে। তা–ও অনেকের কেনার সাধ্য নেই। দরদাম করে অনেককে ফিরে যেতে দেখা গেছে। শুকনা খাবারের দোকানও আছে বেশ কয়েকটি। খই, গজা, জিলাপি থেকে শুরু করে নানা রকম খাবার। গরম খাবারও আছে। কয়েকটি দোকানে পেঁয়াজু ভাজা হচ্ছে। তা কাগজের পোঁটলায় নিয়ে দাঁড়িয়ে খাচ্ছেন কেউ, আবার কথা বলে সময় পার করছেন অনেকে। বাজারের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া সড়কের দুই পাশে অনেকটা জায়গাজুড়ে অনেকে নানা রকম পণ্য নিয়ে বসেছেন।

পেঁয়াজু, জিলাপির মতো খাবারও পাওয়া যায় হাটে। বৃহস্পতিবার বিকেলে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মিরতিংগা হাটে
ছবি: প্রথম আলো

মিষ্টিজাতীয় শুকনা খাবারের দোকান গোবিন্দ চরণ ভট্টাচার্যের। তাঁর বাড়ি শ্রীমঙ্গলের ভৈরববাজার এলাকায়। তিনি জানালেন, ৩০ বছর ধরে তিনি সপ্তাহে ওই এক দিন তলববারে মিরতিংগা বাজারে আসেন। এত দিনে হাটের সঙ্গে, হাটের মানুষের সঙ্গে গভীর একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে।

পরিপাটি করে পান-সুপারি সাজিয়ে বসেছেন মুন্সিবাজারের আবাস মিয়া। তিনি বলেন, ‘আগে বাবা এই বাজারে পান-সুপারি বেচতা (বেচতেন)। ২৫ বছর ধরি আমি বেচি।’
চা-বাগানের অমিত বাড়াইক, পূরণ ওরাওঁ জানান, ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগই বস্তির (চা-বাগানের বাইরের)। তলববারে এক সপ্তাহের কাজ অনুযায়ী একজন চা-শ্রমিক মজুরি পেয়ে থাকেন। এ টাকা থেকেই সপ্তাহের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার করেন তাঁরা।
দেখতে দেখতে বিকেলের আলো আরও ম্লান হয়ে গেছে। অনেক দূরে চা-বাগানের ছায়াবৃক্ষের ওপারে লালচে রং ছড়িয়ে সূর্য ডুবছে। তার আঁচ লেগেছে চা-বাগানের টিলাঘেরা মিরতিংগা বাজারটিতে। বাজারের ছোট ছোট দোকানে দপদপ করে জ্বলে উঠতে থাকে কেরোসিনের কুপিবাতি, কিছু চার্জার বাতিও আছে। তবে কুপিগুলোই যেন মিরতিংগা বাজারের প্রাণ, ওই আলো দিয়েই হাটটি এখনো জিইয়ে রেখেছে তার প্রাণপ্রাচুর্যকে।

কুপিবাতির কাঁপা আলোয় ভালো করে ক্রেতা-বিক্রেতার মুখগুলো দেখা যায় না। তবু মিরতিংগার হাট কেনাবেচা চলে তার নিয়মে
ছবি: প্রথম আলো

যাঁরা কেনাকাটা সেরে ফেলেছেন, তাঁরা মাথায় পুঁটলি রেখে, হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে দল বেঁধে লাইনের (থাকার বসতি) দিকে ছুটে চলছেন। সন্ধ্যার পর মাথায় পণ্যবোঝাই পুঁটলি নিয়ে ঘরের দিকে ফিরছিলেন বিধু ওরাওঁ। তিনি বলেন, ‘চাল কিনছি। শাদা নিছি (নিয়েছি), পান-সুপারি নিছি।’ জানালেন, মাছ কেনেননি। ঘরে কুঁচিয়া মাছ শুকিয়ে রাখা আছে, তাই রান্না করা হবে।

কুপিবাতির কাঁপা আলোয় ভালো করে ক্রেতা-বিক্রেতার মুখগুলো দেখা যায় না। তবু কেনাবেচা চলে তার নিয়মে। মুহূর্তেই যেন হাটটি অনেক বছর আগের সময়কে নিয়ে এসেছে এখানে। কেমন ‘আলোর রহস্যময়ী’ হয়ে উঠেছে অন্ধকার। হাটের গলির ফাঁকে ফাঁকে আলো জ্বলছে। তার ফাঁকে ফাঁকে হাঁটছেন মানুষ। রাত বাড়ে আর ফাঁকা হতে থাকে হাট। এখানে গভীর থেকে গভীরতর অন্ধকার বুকে নিয়ে রাত্রি নামে, রাত্রি বাড়তে থাকে।

হাটের কেনাকাটা শেষে দল বেঁধে বাড়ি ফিরছেন চা-শ্রমিকেরা। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মিরতিংগা চা-বাগানে
ছবি: প্রথম আলো