‘ছেলিডা তো মইরে বাইচেঁছে, উর বাপরে বাঁচাপো ক্যারাম কইরে’
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার একটি দোকানে একদল লোকের দেওয়া আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন উজ্জ্বল হোসাইন (৩০) নামের এক যুবক। গত শুক্রবার রাতে উপজেলার সদর ইউনিয়নের মোক্তারপুরে জানাজা শেষে তাঁর লাশ দাফন করা হয়েছে।
নিহত উজ্জ্বল হোসাইন দামুড়হুদা উপজেলার মোক্তারপুর গ্রামের আলতাফ হোসাইনের ছেলে। তাঁর আরেক ভাইয়ের নাম আহসান আলী। বাবা-ছেলে তিনজনই রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন।
বিজয় মিছিলের নামে ৫ আগস্ট রাতে একদল লোক মোক্তারপুর মোল্লাবাজারে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হাসান আলীর ভাই হোসেন আলীর হার্ডওয়্যার, সার-কীটনাশক ও ইলেকট্রিক পণ্যের দোকানে আগুন লাগিয়ে দেয়। এতে দোকানে থাকা গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে উজ্জ্বল হোসাইন ও তাঁর বাবা আলতাফ হোসাইনসহ (৫০) অন্তত পাঁচজন দগ্ধ হন। এর মধ্যে চারজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুরোনো বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। সেখানে ১১ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর গত শুক্রবার সকাল ৬টায় উজ্জ্বল মারা যান। ময়নাতদন্ত শেষে উজ্জ্বলের লাশ গ্রামের বাড়িতে আনা হয়। সেই সঙ্গে চিকিৎসাধীন তাঁর বাবা আলতাফ হোসাইনকেও বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়।
১১ দিন ধইরে চিকিৎসা কইরেও লোকটার বাঁচাতি পারলাম না। লোকটা সারা জীবনের জন্নি হারি গ্যালো। ট্যাকার অভাবে শ্বশুরের চিকিৎসা না কইরেই বাড়িত নিয়ে আসলাম।
গতকাল শনিবার দুপুরে মোক্তারপুরের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে উজ্জ্বলের স্ত্রী সুরভী খাতুনকে ঘিরে স্বজনদের ভিড় চোখে পড়ে। তাঁরা সুরভীকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। আর সুরভীর দুই চোখ বেয়ে পড়ছিল পানি। কোলে একমাত্র সন্তান সাত বছর বয়সী জুঁই খাতুন হাত দিয়ে মায়ের চোখের পানি মুছে দিচ্ছিল, আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।
সুরভী খাতুন বলেন, ‘১১ দিন ধইরে চিকিৎসা কইরেও লোকটার বাঁচাতি পারলাম না। লোকটা সারা জীবনের জন্নি হারি গ্যালো। ট্যাকার অভাবে শ্বশুরের চিকিৎসা না কইরেই বাড়িত নিয়ে আসলাম। তাঁর কপালে কী আচে আল্লা জানে।’
ঘরের বারান্দায় মেঝেতে নির্বাক শুয়ে ছিলেন দগ্ধ আলতাফ হোসাইন। তাঁর দুই হাত ও দুই পা ব্যান্ডেজ করা হয়। আগুনে পুড়ে মুখ ও বুক থেকে চামড়া উঠে যাওয়ায় তাঁর স্ত্রী নাসিমা খাতুন ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছিলেন। ছেলেকে হারিয়ে কাঁদতে কাঁদতে নাসিমা খাতুনের দুই চোখ লাল হয়ে গেছে। আগুনে পোড়া মুমূর্ষু স্বামীর মাথার পাশে বসে বিলাপ করেন আর বলেন, ‘ছেলিডা তো মইরে বাইচেঁছে, উর বাপরে বাঁচাপো ক্যারাম কইরে?’
প্রতিবেশীরা বলেন, বাবা-ছেলের চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে পরিবারের সদস্যরা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। এখন সরকারি উদ্যোগে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা না হলে হয়তো আলতাফ হোসাইনকেও বাঁচানো যাবে না।