‘শত্রু’ ভেবে ঘুঘু, দোয়েল, বুলবুলি, শালিক মারছেন কৃষকেরা

পাখির আবাসের একেবারে গা ঘেঁষেই কৃষকের ক্ষীরাখেতে টানানো হয়েছে চিকন সুতার জাল। দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন খেতের ওপর কেউ কুয়াশার চাদর বিছিয়েছে। এসব খেতে পোকামাকড়ের খোঁজে বা কচি ক্ষীরা খেতে এসে পাখিরা এ জালে জড়াচ্ছে। এতেই ছটফট করে প্রাণ হারাচ্ছে পাখি।

খেতে দেওয়া জালে আটকে ছটফট করছিল পাখিটি। পরে উদ্ধার করা হয়। গত সোমবার সকালে সন্দ্বীপের চর সন্তোষপুর এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

গাছগাছালিতে ভরা চারপাশ। ভোর আর গোধূলি হলেই শোনা যায় পাখির কিচিরমিচির। বুলবুলি, ফিঙে, ঘুঘু, শালিকসহ নানা প্রজাতির পাখির ডাকে মুখর হয় চারপাশ, তবে এ দৃশ্য যেন হারাতে বসেছে। পাখির আবাস খ্যাত এ এলাকাতেই ফসল বাঁচাতে ফাঁদ বসিয়েছেন কৃষকেরা। এতেই আটকে পড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মরছে পাখি।

চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের সন্তোষপুর ইউনিয়নের বেড়িবাঁধসংলগ্ন এলাকায় দেখা যায় এ দৃশ্যর। গাছপালা বেশি থাকায় ওই এলাকায় সব সময়ই নানা পাখির দেখা মেলে।

সম্প্রতি ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পাখির আবাসের একেবারে গা ঘেঁষেই কৃষকের ক্ষীরাখেতে টানানো হয়েছে চিকন সুতোর জাল। দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন খেতের ওপর কেউ কুয়াশার চাদর বিছিয়েছে। এসব খেতে পোকামাকড়ের খোঁজে বা কচি ক্ষীরা খেতে এসে পাখিরা এ জালে জড়াচ্ছে। এতেই ছটফট করে প্রাণ হারাচ্ছে পাখি।

গত রোববার দুপুরে ক্ষীরাখেতে গিয়ে দেখা যায়, জালের ভেতরে আটকে ছটফট করছে একটি বুলবুলি। পরে এটিকে ছাড়িয়ে দেন প্রতিবেদক। পরের দিন সোমবার গিয়ে দেখা যায় সাদা সুতার জালে আটকে রক্তাক্ত হয়ে রয়েছে আরেকটি বুলবুলি। এটিকেও ছাড়িয়ে দেন প্রতিবেদক। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অধিকাংশ সময়ই এসব পাখি আটকে পড়ার পর কৃষকেরা নিয়ে যান। কোনো পাখি মারা গেলে এটিকে জাল থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। এ কারণে সাধারণত জালে আটকে থাকতে দেখা যায় না। প্রতিদিনই এমন ঘটনা ঘটছে।

‘যত বুলবুলি মরবে, তত আমার ফসলের শত্রু কমবে।’
—কৃষক মো. মহব্বত
কৃষকের জালে আটকে মৃত্যু হয়েছে একটি ফিঙের। গত শুক্রবার তোলা
ছবি: প্রথম আলো

তবে পাখি মরার এসব বিষয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই কৃষকদের। তাঁদের দাবি, এসব পাখি কৃষকের ফসলের শত্রু। এ কারণেই পাখিদের জন্য তাঁরা এমন ফাঁদ রেখেছেন। সরেজমিন জানতে চাইলে একটি খেতের মালিক কৃষক মো. মহব্বত বলেন, পাখিরাই তাঁর ফসলের সবচেয়ে বড় শত্রু। জাল টানানোর পরপরই একটি ফিঙে আটকে পড়ে, তবে তিনি এটাকে ছাড়াননি। অন্য পাখিদের ভয় দেখানোর জন্য এটিকে ফাঁদেই আটকে রেখেছেন।

গত শুক্রবার ফিঙেটি মারা গেলেও সোমবার গিয়েও পাখিটিকে ফাঁদে আটকে থাকতে দেখা যায়। এর বাইরে কয়েকটি বুলবুলিকে তাঁর জালে আটকে থাকতে দেখা যায়। বুলবুলিগুলোকে কেন ছাড়িয়ে দিচ্ছেন না জানতে চাইলে মো. মহব্বত বলেন, ‘ভাবলাম, যত বুলবুলি মরবে, তত আমার ফসলের শত্রু কমবে।’

পাখিদের ‘শত্রু’ মনে করছেন কৃষকেরা

কৃষকদের এসব ফাঁদের কারণে এলাকা থেকে প্রতিনিয়ত কমছে পাখি। স্থানীয় বাসিন্দা মো. মাইনুদ্দিন বলেন, ‘এক দিন একসঙ্গে সাত থেকে আটটি বুলবুলিকে জালে আটকে থাকতে দেখেছি। পরে সেগুলোকে ফাঁদ থেকে ছাড়িয়েছি। এ ছাড়া খেতের পাশের একটি বরইগাছে ডিম দেওয়া ঘুঘু ফাঁদে মারা গেছে। ডিমগুলো এখনো পড়ে আছে। পাখির বাইরেও গুইসাপ আর বেজি এসব জালে আটকে পড়ছে।’

ওই এলাকায় বছরজুড়ে ঘুঘু, শালিক, বাবুই, দোয়েল, বুলবুলি, মাছরাঙা, কাঠঠোকরা, বক ও চিল দেখা মেলে বলে জানান বাসিন্দারা। এ ছাড়া ঋতুভেদে টিয়া, হরিৎ ঘুঘু, রাত চড়া, হুদহুদ, ভারতীয় রবিন ও কালিমের মতো পাখিও দেখা যায়। কিন্তু কৃষিজমিতে পাতা জালের কারণে পাখির বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে।

‘কৃষকেরা ভুল বুঝে উপকারী পাখিকে শত্রু ভাবছেন। জালের বিকল্প ব্যবস্থায় কৃষকদের সচেতন করা জরুরি।’
—বাংলাদেশ বার্ডস ক্লাবের সদস্য তারেক অণু
জালে ঝুলে আছে একটি পাখি
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশ বার্ডস ক্লাবের সদস্য তারেক অণু বলেন, কৃষকেরা ভুল বুঝে উপকারী পাখিকে শত্রু ভাবছেন। পাখি সামান্য ফসল খেলেও কৃষকের উপকারই বেশি করে। জালের বিকল্প ব্যবস্থায় কৃষকদের সচেতন করা জরুরি।

জানতে চাইলে সন্দ্বীপের কৃষি কর্মকর্তা মারুফ হোসেন বলেন, ‘পাখি ঠেকাতে বিষ প্রয়োগে আমরা আপত্তি জানিয়েছি। এখন কারেন্ট জালও পরিহার করতে বলব। পাহারা, ঘণ্টি বা ধাতব ড্রাম ঝুলিয়ে শব্দ তৈরি করে পাখি তাড়ানো যেতে পারে।’