সংসদ সদস্যের বরাদ্দের টাকা তোলা শেষ, কাজের হদিস নেই

বিলগজারিয়া এলাকায় পাকা রাস্তা থেকে জাহিদ মুন্সির বাড়ির পর্যন্ত এই রাস্তাটি ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য করা হয়েছে। সম্প্রতি ফরিদপুর সদর উপজেলার আলিয়াবাদ ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডেছবি: আলীমুজ্জামান

ফরিদপুর সদর উপজেলার কৈজুরি ইউনিয়নের বিল নালিয়ার রাজ্জাকের বাড়ি থেকে ওহাব মুন্সীর জমি পর্যন্ত সড়কে ইট বিছানোর জন্য সংসদ সদস্যের মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে দেড় লাখ টাকা। গত বছরের জুন মাসে ওই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। অথচ এখন পর্যন্ত ওই সড়কে কোনো কাজই শুরু হয়নি। যদিও কাগজে-কলমে প্রকল্প শেষ দেখিয়ে বরাদ্দের টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।

ওই এলাকার বাসিন্দা আফজাল হোসেন (৫০) বলেন, ‘এইডা তো মাটির রাস্তা। ইট যদি বিছাইয়া থাকে, তাহলে সেই ইট খাইলো কেডা?’

এই প্রকল্পের দায়িত্ব পেয়েছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান খন্দকার ইফতেখার মোহাম্মদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই এলাকার মেম্বর আমার পক্ষে এ কাজ করেছেন। আমি এখন ঢাকায়। আমি এলাকায় এসে দেখব কী হয়েছে।’

ফরিদপুর সদর উপজেলার ডিগ্রীরচর ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের চরটেপাখোলা বেপারীডাঙ্গা এলাকায় ফজলুর রহমানের বাড়ি হতে সামাদ পালের বাড়ির অভিমুখে এই সড়কটি নির্মাণের ৪ মাসের মধ্যেই ৩০০ ফুট অংশে ভেঙে পড়েছে
ছবি: প্রথম আলো

ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯৯ লাখ ১৫ হাজার ৩৩৩ টাকা পেয়েছিলেন। সংসদ সদস্যের বিশেষ বরাদ্দের পুরো টাকা ফরিদপুর সদরের একটি পৌরসভা ও ১২টি ইউনিয়নের ৮৫টি প্রকল্পের বিপরীতে খরচ হয়েছে দেখিয়ে চলতি বছরের ১৯ মে তুলে নেওয়া হয়েছে। চলতি বছরের জুনের মধ্যে এসব প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা। তবে সরেজমিনে দেখা গেছে, কৈজুরি ইউনিয়নের বিল নালিয়ার একটি সড়কে ইট বিছানোর মতো অন্তত ১১টি প্রকল্পে কোনো কাজই হয়নি। এ ছাড়া অন্তত ১৭টি প্রকল্পে নামমাত্র কাজ হয়েছে। খন্দকার মোশাররফ বর্তমানে আবুধাবিতে আছেন। দেশ ছাড়ার আগে গত বছরের ১৮ মে প্রকল্পগুলো অনুমোদন দিয়ে যান বলে জানিয়েছেন সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুর রাজ্জাক মোল্লা।

এ বিষয়ে গতকাল মঙ্গলবার রাত নয়টার দিকে মুঠোফোনে কথা হয় খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রকল্প পাস করে দিয়েছি। কাজ বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব ডিসি, ইউএনওদের। কাজে কোনো অনিয়ম হলে কিংবা কেউ কাজ না করলে এটি তাঁদের (ডিসি, ইউএনও) দেখার কথা।’

এসব প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য টাকা ব্যয় করা হয়েছে বাড়িতে ঢোকার ব্যক্তিগত সড়ক ও বাড়ির ভেতরের আঙিনা নির্মাণে। আবার যেসব বাড়ির ভেতরের আঙিনা নির্মাণের কাজ হয়েছে, সেগুলো কোনো না কোনোভাবে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুর রাজ্জাক মোল্লার আত্মীয়।
৮৫টি প্রকল্পের মধ্যে দুই লাখ করে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে জেলা প্রশাসক পরিচালিত জেলা প্রশাসন স্কুল ও কলেজের উন্নয়ন এবং ফরিদপুর কোতোয়ালি থানা কম্পাউন্ডের পুকুরের মাটি খননে। দুটি প্রকল্প বাদে আর কোনো প্রকল্পে দুই লাখ টাকার সমপরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। অন্য প্রকল্পগুলো করা হয়েছে ৫০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকার মধ্যে।

তবে জেলা প্রশাসন স্কুল ও কলেজের কোন খাতে বরাদ্দের টাকা ব্যয় হয়েছে, তা জানা সম্ভব হয়নি। এ ব্যাপারে ওই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ শারমিন সুলতানার মুঠোফোনে পরপর দুই দিন কল করা হয়। তবে ‘অধ্যক্ষ অসুস্থ জানিয়ে’ প্রথম দিন এক নারী শিক্ষক ও দ্বিতীয় দিন এক পুরুষ শিক্ষক ফোন ধরেন। বরাদ্দের অর্থ খরচের বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁরা দুজনই বলেন, ‘ম্যামের কাছ থেকে জেনে আপনাকে জানাচ্ছি।’

বরাদ্দে অসংগতি

সংসদ সদস্য খন্দকার মোশাররফের পৈতৃক বাড়ি সদরের কৈজুরি ইউনিয়নে। সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক মোল্লাও কৈজুরি ইউনিয়নেরই বাসিন্দা। ৮৫টি প্রকল্পের মধ্যে কৈজুরি ইউনিয়নে ১৭টি প্রকল্পের অধীনে সর্বোচ্চ ১৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দের টাকা সমান ভাগ করা হলে পৌরসভা ও প্রতি ইউনিয়নগুলোতে ৭ লাখ ৬২ হাজার ৭১৭ টাকা পাওয়ার কথা। তবে ওই তুলনায় অনেক বেশি বরাদ্দ পেয়েছে কৈজুরি ইউনিয়ন। পক্ষান্তরে সবচেয়ে কম বরাদ্দ পেয়েছে চর মাধবদিয়া ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। চর মাধবদিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মির্জা সাইফুল ইসলাম আজম। সাইফুল ইসলাম ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি।

ফরিদপুর সদর উপজেলার ঈশান গোপালপুর ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের গোপালপুর মাদ্রাসার শৌচাগারের কাজ অসম্পূর্ণ করে রাখা হয়েছে
ছবি: প্রথম আলো

যেখানে কোনো কাজ হয়নি

গত ৭ থেকে ২১ ডিসেম্বরের মধ্যে ওই ৮৫টি প্রকল্প সরেজমিনে দেখা হয়েছে। এর মধ্যে ১১টি প্রকল্পের কোনো কাজ হয়নি। একটি প্রকল্পের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এসব প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ১৩ লাখ টাকা।

চাঁদপুর ইউনিয়নের গজারকান্দি এলাকার আবু শেখের বাড়ি থেকে আয়নাল মল্লিকের বাড়ি পর্যন্ত কাঁচা রাস্তা নির্মাণে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে দেড় লাখ টাকা। তবে এই রাস্তায় কোনো কাজ হয়নি।

ওই এলাকার বাসিন্দা পারভীন বেগম (৪০) বলেন, ‘এলাকার ২০টি পরিবার এ রাস্তা ব্যবহার করে। রাস্তা হবে শুনেছি। কিন্তু এক কোদাল মাটিও তো ফেলা হয়নি।’
এই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেয়েছিলেন আজাদ শেখ। তিনি নিজেকে ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘ওই রাস্তাটি ছোট বিধায় কাজ করা হয়নি। তবে আমরা আরেকটি রাস্তা করেছি। গজারকান্দি ও চরকান্দি অংশে সড়ক করেছি।’

কাজে অনিয়ম

৮৫টি প্রকল্পের মধ্যে প্রায় সব কটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। তবে এসব প্রকল্পের মধ্যে ১৭টি প্রকল্পে নামমাত্র কাজ হয়েছে। অন্য প্রকল্পগুলোর কাজের মান নিয়েও অভিযোগ উঠেছে।  

কৈজুরি ইউনিয়নের ঘোড়াদহ জয়নালের বাড়ি থেকে গফুর ফকিরের বাড়ির সড়কে ইট বিছানো কাজের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এক লাখ টাকা। ওই এলাকার বাসিন্দা গফুর ফকির (৭০) বলেন, নির্মাণের মাসখানেকের মধ্যেই ৭ মিটার রাস্তা দেবে গেছে। ফাঁকা ফাঁকা করে ইট দেওয়া হয়েছে।

ঈশান গোপালপুর ইউনিয়নের ফতেপুর কবরস্থানে মাটি ভরাট ও সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের জন্য বরাদ্দ ছিল এক লাখ টাকা। প্রকল্পের কাজ শেষ দেখানো হলেও কবরস্থানের মাটি ভরাট করা হয়নি। এ ছাড়া কবরস্থানের দুই দিকে চার ফুট উঁচু করে দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। অন্য দুই দিক ফাঁকা পড়ে আছে।

চেয়ারম্যানের যত কাণ্ড

প্রকল্পগুলো ঘুরে ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক মোল্লা বিভিন্ন প্রকল্পে স্বজনপ্রীতি করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কৈজুরি, কৃষ্ণনগর, আলীয়াবাদ মিলে অন্তত ১২টি প্রকল্পের কাজ তিনি তাঁর ভাতিজা এনায়েত হোসেন ওরফে পারভেজকে দিয়ে করিয়েছেন। এনায়েত জেলা যুব শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক। যদিও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিতে (পিআইসি) এনায়েত হোসেনের নাম নেই।

এ ছাড়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই আবদুর রাজ্জাক মোল্লার আত্মীয়স্বজনদের বাড়ির পারিবারিক রাস্তা করা হয়েছে।

কৈজুরির বনগ্রামের জাহাঙ্গীরের বাড়ি থেকে ইসলামের বাড়ি পর্যন্ত সড়ক নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে দেড় লাখ টাকা। তবে এখানে জাহাঙ্গীরের বাড়ির সামনের সড়ক ছাড়াও বাড়ির ভেতর ঘুরে শৌচাগার পর্যন্ত রাস্তা করা হয়েছে।
জাহাঙ্গীর যুব শ্রমিক লীগের নেতা। তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাকের আত্মীয়। জাহাঙ্গীরের এ কাজ বাস্তবায়ন করার কথা থাকলেও কাজ করেছেন এনায়েত হোসেন।

অভিযোগের বিষয়ে এনায়েত হোসেন বলেন, ‘আমি কিছু কাজ করেছি। পাশাপাশি কিছু কাজের নজরদারি করেছি। অনেক জায়গায় পিআইসিতে ছাত্রলীগের কর্মীদের রাখা হয়েছে। তাঁরা অনভিজ্ঞ। এ জন্য তাঁদের কাজ আমাকে করতে হয়েছে। এ ছাড়া চাচা (রাজ্জাক মোল্লা) আগামী নির্বাচনে সদর উপজেলা থেকে দাঁড়াবেন। তাঁর ভাবমূর্তি রক্ষায় আমাকে কাজ করতে হয়েছে।’

কাজে অনিয়মের অভিযোগে আবদুর রাজ্জাক মোল্লা বলেন, ‘কাজে অল্প কিছু অনিয়ম হতে পারে। তবে একেবারে কাজ হয়নি, এমনটি হওয়ার কথা নয়। এক জায়গার কাজের কথা বলে অন্য জায়গায় কাজও হয়ে থাকতে পারে। তবে সংসদ সদস্যের বরাদ্দের টাকার কাজ, তাই এখানে নয়-ছয় হওয়ার সুযোগ নেই। তবে কাজে ভুল হইলে আপনারা একটু ক্ষমাসুন্দর চোখে দেইখেন।’

জানতে চাইলে ফরিদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লিটন ঢালী প্রথম আলোকে বলেন, তিনি গত অর্থবছরের শেষ পর্যায়ে এ উপজেলার দায়িত্ব নিয়েছেন। তাই এ ব্যাপারে তাঁর বেশি তদারকি করা সম্ভব হয়নি। তবে যেসব প্রকল্পের কাজ হয়নি কিংবা অনিয়ম হয়েছে, সেগুলো খুঁজে বের করে ওই প্রকল্প বাস্তবায়নকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।