সুন্দরবনে একটি লাশ, অনেক প্রশ্ন

লাশ পাওয়া যায় একটি। একজনের লাশ আরেকজনের হিসেবে শেষকৃত্য হয়। সন্দেহ থেকে ডিএনএ পরীক্ষা। এতে পাল্টে যায় পরিচয়।

মাহে আলম ও হিলটন নাথ

একটি ডিএনএ পরীক্ষার ফল বদলে দিল সব। হিলটন নাথ হিসেবে খ্রিষ্টান রীতিতে যাঁকে সমাহিত করা হয়েছিল, তিনি আসলে মাহে আলম। ৬৫ বছর বয়সী মাহে আলমের লাশটি কীভাবে ২০ বছরের হিলটনের হয়ে গেল! মাহে আলম মারা গেলেন কীভাবে? হিলটনই–বা কোথায়? এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার কেওড়াতলার বাসিন্দা মাহে আলম। একসময় তাঁর মাছের ঘের ছিল। পাশের চিলা গ্রামে মাছ বিক্রির দোকান ছিল। তবে বয়সের কারণে ব্যবসায় তেমন সক্রিয় ছিলেন না।

গত ১০ এপ্রিল সকালে বাড়ি থেকে বের হন মাহে আলম। দুপুরে তাঁর মুঠোফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। বিকেল গড়িয়ে রাত হয়। তাঁর খোঁজ মেলে না। সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে ১৩ এপ্রিল পরিবারের লোকজন মোংলা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে যান। সেদিন ফিরে আসেন। ১৪ এপ্রিল সকালে ছোট ছেলে সুমন রানা মোংলা থানায় নিখোঁজের জিডি করেন।

মাহে আলমের বড় ছেলে সোহেল রানা বলেন, জিডির পরও বাবার বিষয়ে কিছু জানতে পারেননি। ২০ এপ্রিল মোংলা পৌরসভার সিসিটিভি ক্যামেরার ১০ এপ্রিলের ফুটেজ সংগ্রহ করেন। মামারঘাট এলাকার একটি ক্যামেরার ফুটেজে দেখেন, বাবাকে হাত ধরে একজন মাঝি বাণীশান্তা ঘাটে নিয়ে ট্রলারে তোলেন। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, মাঝির নাম মোশাররফ। তিনি মাহে আলমকে সুন্দরবনের করমজলে নিয়ে গিয়েছিলেন।

একজনকে মেরে বাকি তিনজনকে আদালতে তোলা সম্ভব? তাঁরা তো আদালতকে বলে দেবেন। কারও প্ররোচনায় তাঁরা মিথ্যা বলছেন।
সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মাহাবুব হাসান

‘নিখোঁজ’ হিলটন নাথ

মোংলার যে গ্রামে মাহে আলমের দোকান ছিল, সেই চিলা গ্রামের জেলে হিলটন নাথ। তাঁর ভাই সাগর নাথের ভাষ্য, ৭ এপ্রিল তিনি, হিলটনসহ চারজন নৌকা নিয়ে বাড়ির পাশে পশুর নদে মাছ ধরতে যান। রাত ১২টার দিকে স্পিডবোট নিয়ে বন বিভাগের লোকজন এসে তাঁদের মারধর করেন। এ সময় হিলটন পানিতে পড়ে নিখোঁজ হন। নিখোঁজের বিষয়ে তাঁদের মা বিথিকা রানী ১২ এপ্রিল মোংলা থানায় জিডি করেন।

সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মাহাবুব হাসানের নেতৃত্বে তাঁদের তিনজনকে ধরে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জ অফিসে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ সাগরের। তাঁর দাবি, ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। ৮ এপ্রিল দুপুরে তাঁদের আদালতে পাঠানো হয়। ১৮ এপ্রিল তিনি জামিনে ছাড়া পান।

অভিযোগের বিষয়ে মাহাবুব হাসান বলেন, ‘একজনকে মেরে বাকি তিনজনকে আদালতে তোলা সম্ভব? তাঁরা তো আদালতকে বলে দেবেন। কারও প্ররোচনায় তাঁরা মিথ্যা বলছেন।’ তিনি দাবি করেন, বনে জলদস্যু ও অন্যদের অবৈধ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে তিনি অভিযান শুরু করেছিলেন। ফলে একটি পক্ষ ষড়যন্ত্র করে তাঁকে চাঁদপাই থেকে সরানোর চেষ্টা করে। তারাই এ ঘটনা সাজিয়েছে। তবে তারা কারা, সেই নাম তিনি জানাতে চাননি। এ ঘটনার পর সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জ অফিস থেকে তাঁকে শরণখোলা রেঞ্জে বদলি করা হয়।

লাশ উদ্ধারের খবর পেয়ে দাকোপ থানায় যান মাহে আলমের ছেলেরা। লাশের ছবি দেখে নিশ্চিত হন, লাশটি তাঁদের বাবার। যে কাপড় পরে তিনি বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন, লাশের পরনে সেই পোশাক ছিল।

পাওয়া গেল একটি লাশ

১৩ এপ্রিল রাতে একটি গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশটি পাওয়া যায় মোংলার অদূরে সুন্দরবনের করমজল বন্য প্রাণী প্রজননকেন্দ্র এলাকায়। এটি খুলনার দাকোপ থানায় পড়েছে। লাশটি উদ্ধার করে দাকোপ থানার পুলিশ। সুরতহালের পর ময়নাতদন্তের জন্য লাশটি খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

পরদিন বিকেলে চিলা গ্রামের কয়েকজনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দাকোপ থানার পুলিশ লাশটি হিলটনের পরিবারকে দেয়। ওই দিন অবশ্য মাহে আলম নিখোঁজের ঘটনায় জিডির বিষয়টি আশপাশের থানাকে জানিয়েছিল মোংলা থানা।

এদিকে লাশ উদ্ধারের খবর পেয়ে দাকোপ থানায় যান মাহে আলমের ছেলেরা। লাশের ছবি দেখে নিশ্চিত হন, লাশটি তাঁদের বাবার। যে কাপড় পরে তিনি বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন, লাশের পরনে সেই পোশাক ছিল। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে লাশটি কার, সেটা জানার জন্য ২৮ এপ্রিল দাকোপ থানায় জিডি করেন।

সুরতহাল প্রতিবেদনের সঙ্গে এই কথা মিলে যায়। পোশাকের বর্ণনার ঘরে বলা আছে, লাশের গায়ে ফুলহাতা গেঞ্জি, কালো ফুলপ্যান্ট ও কোমরে বেল্ট। চুলের রং ও ধরনের ঘরে লেখা, ‘নাই’। হিলটনের ভাই সাগর বলেছিলেন, নিখোঁজের রাতে ভাইয়ের পরনে গেঞ্জি ও হাফপ্যান্ট ছিল।

লাশটি এল কোথা থেকে

করমজলে সুন্দরবন ভ্রমণে যাওয়া দর্শনার্থীদের হাঁটার একটি পথ আছে। সেটার পাশ থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়। স্থানীয় তিনজন বাসিন্দা ও বন বিভাগের দুজন কর্মী বলেন, রাতে যখন লাশটি উদ্ধার করা হয়, এর কয়েক ঘণ্টা আগেও সেখানে কোনো লাশ দেখা যায়নি। লাশ পড়ে থাকলে অবশ্যই দর্শনার্থীদের নজরে পড়ত, সেটা নিয়ে কথা হতো। রোজার সময় হওয়ায় ইফতারের প্রস্তুতির জন্য বিকেলের দিকে দর্শনার্থীরা চলে যান। দুর্বৃত্তরা এই সময়কে কাজ লাগিয়ে লাশটি এখানে ফেলে যান। লাশ থেকে কেরোসিনের গন্ধ আসছিল। হত্যার পর লাশটি ট্রলারের ভেতরে রাখায় হয়তো এমন গন্ধ।

স্থানীয় লোকজনের দাবি, লাশ যেখানে পাওয়া গেল, সেখানকার কাছাকাছি খালে সন্ধ্যার কিছু আগে একটি ট্রলার দেখা যায়। সেই ট্রলারে করে লাশটি আনা হতে পারে। ট্রলারটি চলে যায়। পরে দুটি ট্রলার ওই খালে আসে। ট্রলারে আসা লোকজন লাশ পাওয়া গেছে বলাবলি করতে থাকেন। ট্রলারে আসা-যাওয়া করা লোকগুলোর মধ্যে যোগসূত্র থাকতে পারে।

করমজল পর্যটন ও বন্য প্রাণী প্রজননকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, বনের যে স্থানে লাশটি পাওয়া গেছে, তা বেশ উঁচু। খাল থেকেও দূরে। লাশ উদ্ধারের আগের সময়টায় নদীতে উঁচু জোয়ার ছিল না। ফলে লাশটি সেখানে ভেসে আসা সম্ভব নয়। অন্য কোথাও থেকে লাশটি এনে এখানে ফেলা হয়।

লাশের খবর পাওয়া গেল কীভাবে

দাকোপ থানার ওসি উজ্জ্বল দত্ত বলেন, প্রথমে ১০ এপ্রিল ৯৯৯-এর মাধ্যমে একটি লাশের খবর পান। কিন্তু নৌপুলিশ ও কোস্টগার্ডের সহযোগিতা নিয়েও লাশ পাননি। এর তিন দিন পর ৯৯৯-এর মাধ্যমে পুলিশ করমজলে লাশ পড়ে থাকার খবর পায়। মোংলার চিলা গ্রামের কয়েকজন এসে দাবি করেন, লাশটি তাঁদের গ্রামের নিখোঁজ জেলে হিলটন নাথের। তখন লাশটি হিলটনের পরিবারকে দেওয়া হয়।

নিখোঁজের জিডি এবং পরে কোনো লাশ পাওয়া গেলে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া সম্পর্কে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেছেন, পোশাক বা শারীরিক চিহ্ন দেখে দাবিদার লাশ শনাক্ত করেন। তাঁদের দাবির বিষয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির (ইউপি চেয়ারম্যান বা ইউপি সদস্য) কাছে জানতে চায় পুলিশ। তাঁরা মৌখিক বা লিখিত প্রত্যয়ন দিলে অপমৃত্যুর মামলা হয়। আশপাশের থানায় বেতারবার্তা পাঠানো হয়। এরপর লাশটি বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়াগুলো অনুসরণ করে দাকোপ থানা লাশটি হস্তান্তর করেছিল কি না, জানতে চাইলে ওসি কোনো কথা বলতে চাননি।

এই থানারই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, ‘এটা নিশ্চিত, লাশটি করমজলে ভেসে আসেনি। কারা হত্যা করেছে, কারা লাশ করমজলে ফেলেছে, তার তদন্ত চলছে।’

স্থানীয় লোকজনের সন্দেহ, লাশ পাওয়ার খবর দুবার পুলিশকে জানিয়েছে একই পক্ষের লোকজন।

লাশ ঘিরে রহস্য

করমজলে লাশ উদ্ধারের সময় থাকা এক ব্যক্তির মুঠোফোনে করা ১ মিনিট ১০ সেকেন্ডের একটি ভিডিও পাওয়া গেছে। সেখানে একজনকে বলতে শোনা যায়, ‘এর তো ফুল প্যান্ড (প্যান্ট) পরা। মিলে নাই তো।’ তখন অন্য একজনকে বলতে শোনা যায়, ‘এর মাথায় চুল নেই তো।’

সুরতহাল প্রতিবেদনের সঙ্গে এই কথা মিলে যায়। পোশাকের বর্ণনার ঘরে বলা আছে, লাশের গায়ে ফুলহাতা গেঞ্জি, কালো ফুলপ্যান্ট ও কোমরে বেল্ট। চুলের রং ও ধরনের ঘরে লেখা, ‘নাই’। হিলটনের ভাই সাগর বলেছিলেন, নিখোঁজের রাতে ভাইয়ের পরনে গেঞ্জি ও হাফপ্যান্ট ছিল।

লাশটি যাঁর, তাঁর মৃত্যু কীভাবে হয়েছে, সে বিষয়ে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে কিছু লেখা নেই। সেখানে বলা হয়েছে, মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করা যায়নি। এর জন্য আনুষঙ্গিক তথ্যপ্রমাণের ওপর নির্ভর করতে হবে।

ভিডিওর কথা উল্লেখ করে মাহে আলমের ছেলে সোহেল রানার দাবি, লাশটি যে হিলটন নাথের নয়, এ ব্যাপারে ওই লোকগুলো নিশ্চিত ছিলেন। তাহলে লাশটি কেন নিয়েছেন, সেই উত্তর মেলাতে পারছেন না তিনি।

এদিকে লাশটি যখন হিলটনের হিসেবে তাঁর মা বীথিকা রানীর কাছে হস্তান্তর করা হয়, তখন হিলটনের ভাই সাগর বন বিভাগের মামলায় কারাগারে ছিলেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মাকে তারা বুঝাইছে।’ লাশটি বুঝে নেওয়ার জন্য হিলটনের পরিবারের ওপর চাপ ছিল। তবে কারা সেই চাপ দিয়েছিলেন, সে বিষয়ে তিনি কথা বলতে চাননি।

মাহে আলমের পরিবারের ভোগান্তি

যে মোশাররফ মাঝিকে সর্বশেষ মাহে আলমের সঙ্গে দেখা গেছে, তাঁর বিরুদ্ধে মোংলা থানায় অপহরণের মামলা করতে চেয়েছিলেন ছেলেরা। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজও দেখান পুলিশকে। তবে পুলিশ মামলা নিতে চায়নি, ২৯ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে এমন অভিযোগ করে মাহে আলমের পরিবার। পরে ২ মে মাহে আলমের ছোট ছেলে সুমন রানা বাগেরহাটের আদালতে যান। থানায় নিয়মিত মামলা হিসেবে নেওয়ার জন্য আরজি জানান। আদালত ৭ মে মোংলা থানাকে নিয়মিত মামলা হিসেবে রেকর্ড করার আদেশ দেন।

মাহে আলমের বড় ছেলে সোহেল রানা বলেন, আগস্টের শুরুর দিকে দেওয়া ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদনে জানতে পারেন, লাশটি তাঁর বাবার। লাশটি পাওয়ার জন্য মোংলা থানা, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, আদালতের অনেক ঘোরাঘুরি করেন। তবে এখনো বাবার লাশটি ফেরত পাননি। লাশটি দাফনের অপেক্ষায় আছেন তাঁরা।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোংলা থানার এসআই বলেন, ডিএনএ প্রতিবেদন অনুযায়ী হিলটন নাথ হিসেবে দাফন করা লাশটি মাহে আলমের। তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে তিনি বাগেরহাটের আদালতে লাশ উত্তোলনের আবেদন করেছেন। ডিএনএর মূল প্রতিবেদনটি খুলনার হিলটন নাথ হত্যা মামলার নথি হিসেবে সেখানকার আদালতে। লাশটিও এখনো মোংলার চিলা গ্রামে হিলটন নাথের বাড়িতে দাফন অবস্থায়। আর মাহে আলম অপহরণ মামলাটি লাশ উত্তোলন করে হস্তান্তরের পর হত্যা বা অপমৃত্যুর মামলার ধারা যুক্ত হবে।

মামলায় জড়ালেন নৌকার মাঝি

অপহরণের মামলায় নৌকার মাঝি মোশাররফকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। বর্তমানে তিনি জামিনে আছেন। তিনি বলেন, ৩০০ টাকা ভাড়া নিয়ে তিনি মাহে আলমকে করমজলে পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে কোনো লেনদেন বা শত্রুতা নেই। ফেরার সময় মাহে আলম তাঁর ফোন নম্বর নেন। বলেছিলেন, তাঁর কাছে কিছু লোক আসবেন। যদি ফেরার সময় লাগে, তাহলে কল দেবেন।

পুলিশ বলছে, মামলার ভিত্তিতে মোশাররফকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পুরো বিষয়টি এখন তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

হিলটন তাহলে কোথায়

হিলটন নাথ এখন কোথায়—সেই প্রশ্ন তাঁর পরিবার ও গ্রামের মানুষের। বাড়ির আঙিনায় সমাহিত লাশটি ছেলের নয়, জানার পর হিলটনের মা বীথিকা রানী আশায় বুক বেঁধেছেন। মন বলছে, ছেলে বেঁচে আছে। একদিন সে মায়ের কাছে ফিরবে!