ছাতু-গুড় থেকে বুটবিরিয়ানি

নানা পদের ইফতারি বিক্রি হচ্ছে। ২৬ মার্চ বিকেলে রংপুরের কাচারিবাজারে
মঈনুল ইসলাম

সত্তর কিংবা আশির দশকে রংপুর ছিল অভাবপীড়িত এলাকা। তখন রমজানে মাসে ইফতার হতো একদম সাদামাটা। ইফতারির অন্যতম পদ ছিল গম ও ভুট্টার ছাতু। সঙ্গে ছিল দানাদার গুড় ও কলা। ইফতারিতে অন্য কোনো পদের কথা চিন্তা করতে পারতেন না বেশির ভাগ মানুষ।

সময়ের পরিক্রমায় বদলে গেছে সেই দিন। এখন ঘরে ঘরে রকমারি ইফতারি বানানো হয়। দোকানেও বিক্রি হয় নানা পদ। তবে সবার ইফতারির থালায় এখন থাকে অভিন্ন পদ বুটভুনা, বুটবিরিয়ানি আর জিলাপি।

রংপুর শহরের বাসিন্দা মোহাম্মদ শাহ আলম। গ্রামের বাড়ি জেলার পীরগাছা উপজেলায়। ছোটবেলা থেকেই রোজা পালন করে আসছেন প্রবীণ এই শিক্ষাবিদ। তাঁর সঙ্গে কথা হলো পুরোনো দিনের ইফতারি প্রসঙ্গে। জানালেন, এমনিতেই রংপুর ছিল মঙ্গাপীড়িত অঞ্চল।

রংপুরে ইফতারে বুটবিরানির চাহিদা বেশি
ছবি: প্রথম আলো

সে সময় শিশু–কিশোরসহ সব বয়সী মানুষের রোজা রাখার প্রবণতা ছিল। প্রতিদিন ইফতারিতে অন্যতম পদ ছিল গম কিংবা ভুট্টার ছাতু। এই জিনিসটার দামও কম ছিল। সহজে বাজারে মিলত। অবস্থাপন্ন মানুষজন জমিতে গম–ভুট্টার আবাদ করতেন, তাঁরা মিল থেকে ভেঙে আনতেন ছাতু। বিলিয়ে দিতেন গ্রামের মানুষকে।

মোহাম্মদ শাহ আলম বলছিলেন, বাজারে ওই সময় মাটির হাঁড়ির মধ্যে দানাদার গুড় কিনতে পাওয়া যেত। এই দানাদার গুড় খেতেও খুব মজা। ছাতুর সঙ্গে গুড়–পানি মিশিয়ে তৈরি হতো মজাদার ইফতারি। এটি আবার পানির কমবেশি ব্যবহারে পাতলা ও শক্ত করা যেত। এই ছাতুর সঙ্গে কেউ কেউ কলাও (বিশেষ করে আটিয়া কলা) মেখে নিতেন। এই ইফতারি ছিল খুব স্বাদের। পেট ঠান্ডা থাকত।

অনেক বছর ধরেই বদলে গেছে রংপুরের গ্রাম–শহরের দৃশ্যপট। ছাতু–গুড়ের ইফতারি এখন নেই বললেই চলে। মানুষজনের হাতে কিছু পয়সা এসেছে। রংপুরকেও আর অভাবপীড়িত অঞ্চল বলা যায় না। এর সঙ্গে বদলে গেছে মানুষের রুচি–অভ্যাস।

এখন নানা পদের ইফতারি বিক্রি হচ্ছে হোটেল–রেস্তোরাঁগুলোতে। নগর–জনপদের প্রতিটি মহল্লায় হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় ইফতারসামগ্রী। কেনাকাটাও মন্দ নয়। এখন বাজারে যেসব ইফতারি পাওয়া যায়, এর মধ্যে রয়েছে মুরগির রেজালা, মুরগির গ্রিল, চিকেন ফ্রাই, খাসির রেজালা, হালিম, রেশমি জিলাপি, শাহি জিলাপি, সানা পোলাও, জালি কাবাব, ঝুরিভাজা, বুন্দিয়া, আলুর চপ, মাটন চপ, ডিম চপ, পেঁয়াজু, বেগুনি, চিড়াভাজা।

রোববার ইফতারি কিনতে আসা বিভিন্ন বয়সী অন্তত ২০ ব্যক্তির সঙ্গে কথা হলো। তাঁদের কথা, এখন বাসাবাড়িতে নানা পদের ইফতারি তৈরি হয়। কমবেশি প্রতিটি বাড়িতেই তৈরি হয় বুটভুনা (ছোলা), বুটবিরিয়ানি আর জিলাপি। এই তিনটি বলা চলে অভিন্ন পদ।

জিলাপির জন্য নামকরা শহরের নবাবগঞ্জ বাজারের মুসলিম মিষ্টান্ন ভান্ডার। ৬৩ বছর ধরে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে আসছে দোকানটি। এদের জিলাপির কদর এখনো আছে। এখানকার জিলাপি একসময় বাঁশের খাঁচায় বিক্রি হতো। স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতে গেলে মিষ্টি হিসেবে জিলাপির খাঁচাই থাকত। স্বাধীনতা–পূর্ববর্তী সময়ে এ জিলাপি বিক্রি হতো প্রতি সের পঞ্চাশ পয়সা। এখন তা ১৬০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। বংশপরিক্রমায় চলে আসছে তাদের ব্যবসা। মুসলিম মিষ্টান্ন ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী ছিলেন শালবন এলাকার বাসিন্দা আবুল কাশেম। তিনি মারা যাওয়ার পর চার ছেলে ব্যবসার হাল ধরেন। দুই ছেলের মৃত্যুর পর বাকি দুই ছেলে এখন ব্যবসা দেখছেন। এঁদের একজন জাহাঙ্গীর কবির। তিনি বলেন, ‘গুড়ের জিলাপির কদর এখনো আছে। রমজানে বিক্রি বেড়ে যায়। প্রতিদিন জিলাপি বিক্রি হয় চার থেকে পাঁচ মণ।’

সরেজমিনে দেখা গেল, শহরে ইফতারি বিক্রির ধুম পড়েছে। বড় বড় রেস্তোরাঁ ছাড়াও পাড়া–মহল্লার মোড়ের দোকানেও বিক্রি কম নয়। কাচারি বাজার এলাকা ইফতারি বিক্রির সবচেয়ে বড় বাজার।

এখানে একসঙ্গে লাগোয়া পাঁচটি বড় দোকান। ইফতারির কোন খাবারটির চাহিদা বেশি—এমন প্রশ্নের জবাবে মহুয়া কনফেকশনারির স্বত্বাধিকারী নূরুল হক বলেন, জিলাপি, বুটভুনা ও বুটবিরিয়ানি। বিভিন্ন ইফতার অনুষ্ঠানেও এই তিনটির কদর বেশি।

সেখানে ইফতারি কিনতে আসেন তৌফিকুল ইসলাম নামের এক তরুণ। তিনি বলেন, ‘ইফতারে যা–ই খাই না কেন, বুটবিরিয়ানি আর জিলাপি না খেলে তৃপ্তিই পাওয়া যায় না।’