দল অংশ না নেওয়া নির্বাচনে ভোট দিলেন বিএনপির জনপ্রতিনিধিরা

ঠাকুরগাঁও জেলা পরিষদ নির্বাচনের সদর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনের ভোটকেন্দ্র
ছবি: প্রথম আলো

এই সরকারের অধীন কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না বিএনপি—এই অবস্থানের কারণে জেলা পরিষদ নির্বাচনে কোনো প্রার্থী দেয়নি দলটি। চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র হয়েও বিএনপির কেউ নির্বাচনে অংশ নেননি। কিন্তু সেই নির্বাচনেই ঠাকুরগাঁওয়ে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত জনপ্রতিনিধিরা দল বেঁধে ভোট দিয়েছেন।

বিএনপি নেতারা বলছেন, দল যখন আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছে, তখন জেলা পরিষদ নির্বাচনে জনপ্রতিনিধিরা ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জয়ে সহায়তা করছেন, যা অনৈতিক। তবে ভোট দেওয়া বিএনপির জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, এলাকার উন্নয়নের স্বার্থেই তাঁদের ভোট দিয়ে হয়েছে।

ঠাকুরগাঁওয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় চেয়ারম্যান পদে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের বর্তমান প্রশাসক মু. সাদেক কুরাইশী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। জেলা পরিষদের ৫টি সাধারণ ওয়ার্ড ও ২টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড রয়েছে। সাধারণ ওয়ার্ডের ১৯ প্রার্থীর মধ্যে ১৫ জনই আওয়ামী লীগের নেতা। ২ জন বিএনপির, ১ জন জাতীয় পার্টির এবং নির্দলীয় প্রার্থী ছিলেন ১ জন। সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ১০ জন প্রার্থীর ৯ জনই আওয়ামী লীগের নেতা এবং ১ জন নির্দলীয় প্রার্থী।

আজ সকাল নয়টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত ইভিএমে ভোট গ্রহণ করা হয়। মূলত সব ওয়ার্ডেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে।

সোয়া ১০টার দিকে সদর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনের ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে আসেন রহিমানপুর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান আবু হাসান মো. আবদুল হান্নান। তিনি জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে ভোট দেওয়ার জন্য কেন্দ্রে আসেন জগন্নাথপুর ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি জেলা বিএনপির ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পবিষয়ক সম্পাদক। আর বেলা পৌনে দুইটার দিকে ভোট দেন বালিয়া ইউনিয়নের জেলা বিএনপির অর্থবিষয়ক সহসম্পাদক জুলফিকার আলী।

ভোট শেষে জুলফিকার আলী বলেন, ‘ভোট আমার নাগরিক অধিকার। তা ছাড়া আমি স্বতন্ত্র নির্বাচন করে চেয়ারম্যান হয়েছি। এই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিচ্ছে না। কিন্তু ভোট তো হচ্ছে। তাই জেলা পরিষদের মাধ্যমে এলাকার উন্নয়নের জন্য ভোট দিয়েছি।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির এক জনপ্রতিনিধি বলেন, যে নির্বাচনে কেবল আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন, সেখানে তাঁদেরই ভোট দিতে হয়েছে।

জনপ্রতিনিধির জায়গা থেকে হয়তো দলের নেতারা জেলা পরিষদের ভোট দিতে গিয়েছিলেন। বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে ভোট প্রদানের বিষয়ে দলীয় কোনো নির্দেশনা ছিল না। তবে এই সরকারের অধীন সব নির্বাচনে বিএনপির সব নেতা-কর্মীদের ভোট প্রদানেও বিরত থাকা উচিত।
তৈমুর রহমান, সভাপতি, ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপি

দুপুর ১২টার দিকে একই ভোটকেন্দ্রে আসেন ঠাকুরগাঁও পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আতাউর রহমান এবং ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম। তাঁরা দুজনই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও পৌর বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আতাউর রহমান বলেন, বিএনপি ভোটে অংশ নিচ্ছে না। আর জেলা পরিষদের সদস্যদের নির্বাচন তো দলীয়ভাবে হচ্ছে না। ভোট প্রদানে দলের তো কোনো নিষেধ ছিল না। তিনি ছাড়াও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রমজান আলী ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আয়শা বানুও ভোট দিয়েছেন বলে জানান আতাউর।

এ ছাড়া হরিপুর উপজেলার হরিপুর ইউপির চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম, গেদুড়া ইউপির চেয়ারম্যান তরিকুল ইসলাম ভোট দিয়েছেন। তাঁরা দুজনেই হরিপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি। এ ছাড়া উপজেলা বিএনপির সাবেক কৃষিবিষয়ক সম্পাদক ও ডাঙ্গীপাড়া ইউপির চেয়ারম্যান আহসান হাবিব চৌধুরীও ভোট দিয়েছেন।

ভোটারের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছেন ঠাকুরগাঁও জেলা পরিষদ নির্বাচনের এক প্রার্থী
ছবি: প্রথম আলো

পীরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্য সুকুমার রায়, হরিপুর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ও হরিপুর ইউপি চেয়ারম্যান মোখলেছুর রহমান চৌধুরী, কোষারানীগঞ্জ ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা এবং উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি ও সেনগাঁও ইউপির চেয়ারম্যান সাইদুর রহমানও ভোট দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে সুকুমার রায় বলেন, ‘সংরক্ষিত ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেতেরা হকের ছেলে আমার বাল্যবন্ধু। তাঁর অনুরোধেই ভোট দিতে গিয়েছিলাম।’

গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘আমাদের এই ওয়ার্ডে দলের একজন প্রার্থী আছেন। তাঁর জয়ের কোনো সম্ভাবনাই নেই। তাই তাঁকে ভোট দিতে পারিনি। ভোট দিতে হয়েছে আওয়ামী লীগের অপেক্ষাকৃত ভালো প্রার্থীকে। তাঁর মাধ্যমে আমার এলাকায় উন্নয়ন করতে পারব। আপনি বলতে পারেন উন্নয়নের স্বার্থেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট দিতে হয়েছে।’

বাড়ির পাশেই ভোটকেন্দ্র হওয়ায় নির্বাচন দেখতে এসেছিলেন শহরের হাজীপাড়া মহল্লার বাসিন্দা শহিদুল হক। কেন্দ্রের বাইরে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, বিএনপির নেতারা এই সরকারের অধীন কোনো ভোটে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এই তাঁরাই আবার দল বেঁধে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকেই ভোট দিয়ে গেলেন। এটা কি রসিকতা নয়?

জেলা বিএনপির সহসভাপতি ওবায়দুল্লাহ মাসুদ দলের নেতাদের ভোট প্রদান করতে যাওয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘এখন আমরা আন্দোলন গড়ে তুলে সরকার পতনের চেষ্টা করে যাচ্ছি। ঠিক সেই সময় আমাদের দলের নেতারা জেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোট দিয়ে সরকারদলীয় লোকজনের জয়ে সহায়তা করে তাঁদের শক্তি বাড়াচ্ছেন। এটা অনৈতিক ও দলের সঙ্গে একপ্রকার প্রতারণা।’

জানতে চাইলে জেলা বিএনপির সভাপতি তৈমুর রহমান বলেন, ‘জনপ্রতিনিধির জায়গা থেকে হয়তো দলের নেতারা জেলা পরিষদের ভোট দিতে গিয়েছিলেন। বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে ভোট প্রদানের বিষয়ে দলীয় কোনো নির্দেশনা ছিল না। তবে এই সরকারের অধীন সব নির্বাচনে বিএনপির সব নেতা-কর্মীদের ভোট প্রদানেও বিরত থাকা উচিত।’

বেলা আড়াইটা থেকে তিনটার মধ্যে ঘোষিত বেসরকারি ফলাফলে জানা যায়, ঠাকুরগাঁও জেলা পরিষদ নির্বাচনে ১ নম্বর সাধারণ ওয়ার্ডে জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ দত্ত, ২ নম্বর ওয়ার্ডে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সফিকুল ইসলাম, ৩ নম্বর ওয়ার্ডে পীরগঞ্জ উপজেলার সেনগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মোস্তাফিজার রহমান, ৪ নম্বর ওয়ার্ডে জেলা যুবলীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আবদুল বাতিন এবং ৫ নম্বর ওয়ার্ডে জেলা কৃষক লীগের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক মো. আনিসুজ্জামান বিজয়ী হয়েছেন। আর সংরক্ষিত ১ নম্বর ওয়ার্ডে আফসানা আখতার ও সংরক্ষিত ২ নম্বর ওয়ার্ডে হরিপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক সাবিনা ইয়াসমিন নির্বাচিত হয়েছেন।